তাবিথ আউয়ালের হাত ধরেই জেগে উঠুক রঙহীন ফুটবল
কাজী সালাউদ্দিন যুগের অবসান শেষে বাফুফের নতুন সভাপতি হিসেবে আসীন হয়েছেন সাবেক ফুটবলার এবং তরুণ রাজনীতিক তাবিথ আউয়াল। ক্রীড়া এবং রাজনীতি কোনো অঙ্গনেই তিনি অপরিচিত কেউ নন। তারুণ্যময়, উচ্ছল-প্রাণবন্ত তাবিথ বাফুফের সভাপতি পদে ১২৩ ভোট পেয়ে বড় ব্যবধানে জিতেছেন। সভাপতি পদে মোট ভোট পড়ে ১২৮টি। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মিজানুর রহমান চৌধুরী পান মাত্র ৫ ভোট। আসলে আগে থেকেই অনুমেয় ছিল যে, তাবিথ আউয়াল এ রকম একপেশে ভোট ব্যবধানেই জিতবেন। তার জয় ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। কেননা দূর গাঁও থেকে আসা মিজানুর রহমান চৌধুরী যে কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারবেন না তা সবারই জানা ছিল আগেভাগেই।
গত ৫ আগস্ট সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ফুটবল প্রসঙ্গ উঠে এলে সভাপতি পদকে ঘিরেই তৈরি হচ্ছিল নানান কথামালা। বিশেষ করে একটানা প্রায় ১৬ বছর ধরে সভাপতি পদে থাকা বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিনকে ক্রীড়ামোদী এবং নীতিনির্ধারকদের বড় অংশই আর সহ্য করতে পারছিলেন না। ২০০৮ সাল থেকে কাজী সালাউদ্দিন বহুবিধ স্বপ্ন দেখালেও ফুটবলকে সেই অর্থে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থই হয়েছেন। এ কথা সত্য যে, কাজী সালাউদ্দিন প্রথম বাফুফের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কথার রঙ ছড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ধারাবাহিক ফুটবল ব্যর্থতার কারণে বারবার তিনি সর্বত্র নিন্দিত হতে থাকেন। একবার তাই রাগে-ক্ষোভে তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘আমি তো মাঠে গিয়ে খেলে দিতে পারি না।’ পটপরিবর্তনের পরও তিনি ফের সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন বলে আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু পরে পরিস্থিতি বুঝে তিনি নিজেই ঘোষণা দেন আর বাফুফে সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন না। এর পরই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাবিথ আউয়ালই হবেন পরবর্তী সভাপতি। কাজী সালাউদ্দিন অধ্যায় শেষ।
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়াল সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে কাছে পেয়েছেন অভিজ্ঞ ক্রীড়া সংগঠক ইমরুল হাসানকে। যিনি আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এদিকে বাফুফেতে এবার বেশ কয়েকজন নতুন মুখের আগমন ঘটেছে। সহসভাপতি হিসেবে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে এসেছেন সাবেক এমপি, বিশিষ্ট ব্যবসীয় রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান নাসের শাহরিয়ার জাহেদী। এ ছাড়া রয়েছেন ওয়াহিউদ্দীন চৌধুরী হ্যাপি, সাব্বির আহমেদ আরেফ এবং ফাহাদ করিম। ১২৭ ভোটের মধ্যে নাসের শাহরিয়ার জাহেদী সর্বোচ্চ পেয়েছেন ১১৫ ভোট, ওয়াহিদউদ্দীন চৌধুরী (হ্যাপি) পেয়েছেন ১০৮ ভোট, সাব্বির আহমেদ আরেফ পেয়েছেন ৯০ ভোট এবং ফাহাদ করিম পেয়েছেন ৮৭ ভোট। হেরে যাওয়া দুই সাবেক তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির ৬৬ ভোট আর কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক ৪২ ভোট পেয়েছেন। এদিকে নির্বাচনে মোট ১৫টি সদস্য পদে ৩৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জয়ী ১৫ জন হলেনÑ ইকবাল হোসেন (প্রাপ্ত ভোট ৯৮), দ্বিতীয় আমীরুল ইসলাম বাবু (প্রাপ্ত ভোট ৯৬), তৃতীয় মো. গোলাম গাউছ (প্রাপ্ত ভোট ৯২), চতুর্থ মাহি উদ্দিন আহমেদ সেলিম (প্রাপ্ত ভোট ৮৮), পঞ্চম টিপু সুলতান (প্রাপ্ত ভোট ৮৭), ষষ্ঠ মো. মঞ্জুরুল করীম (প্রাপ্ত ভোট ৮৭), সপ্তম জাহির হোসেন চৌধুরী (প্রাপ্ত ভোট ৮২), অষ্টম মাহফুজা আক্তার কিরণ (প্রাপ্ত ভোট ৮১), নবম কামরুল হাসান হিলটন (প্রাপ্ত ভোট ৮১), দশম সত্যজিত দাশ রুপু (প্রাপ্ত ভোট ৭৬), এগারোতম ইমতিয়াজ হামিদ সবুজ (প্রাপ্ত ভোট ৭২), বারোতম মো. ছাইদ হাসান কানন (প্রাপ্ত ভোট ৬৭), তেরোতম সাখাওয়াত হোসেন ভুঁইয়া শাহীন (প্রাপ্ত ভোট ৬৬), চৌদ্দতম বিজন বড়ুয়া (প্রাপ্ত ভোট ৬২), পনেরোতম মো. এখলাস উদ্দিন (প্রাপ্ত ভোট ৬১), মো. সাইফুর রহমান মণি (প্রাপ্ত ভোট ৬১)।
তাবিথ আউয়াল সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সর্বত্র অভিনন্দিত হয়েছেন। তিনি জয়ী হওয়ার পর সুন্দর প্রতিক্রিয়াও দিয়েছেন। ফুটবলাঙ্গনে সংস্কার বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সকলেই একমত যে, ফুটবলে আমরা সংস্কার আনতে চাই। এ কারণে আমরা শুরুতে আমাদের গঠনতন্ত্র ও পরিকল্পনার জায়গায় সংস্কারের কর্মসূচিগুলো হাতে নেব। একই সঙ্গে মাঠের ফুটবল যেন চলমান থাকে এবং আরও উচ্চ পর্যায়ে চলে যায়, সে ব্যাপারে আমরা কাজ শুরু করব।’ তাবিথ আউয়ালের এই কথার মধ্যে অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে। তবে এ-ও ঠিক যে, তার সামনে রয়েছে বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটি হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফুটবলের শক্তির জায়গাটি তৈরি করা। দেশের ফুটবলকে তাই পদ্ধতিগতভাবে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ভিশন ও পরিকল্পনা। ভিশন ও পরিকল্পনা ছাড়া কোনোভাবেই ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। কেননা দক্ষিণ এশিয়াসহ সব দেশই তাদের ভিশন ঠিক রেখে এগোচ্ছে। কিন্তু ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, পরিকল্পনায় ভুল হলে ফুটবল আগের মতোই ধুঁকে ধুঁকে মরবে। ফুটবল আরও জৌলুস হারাবে। ফুটবল নিয়ে শুধু কথা হবে, রাজনীতি হবে, কিন্তু সাফল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। এশিয়াে তো দূরে থাক, দক্ষিণ এশিয়াই লেভেলে আমরা কিছুই করার ক্ষমতা দেখাতে পারব না। বিগত দিনে আমরা দেখেছি ফুটবলে মূল কাজের চেয়ে কথা হয়েছে বেশি। আর তাই বরবার আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আর আমাদের ফুটবলের সোনালি অধ্যায় চাপা পড়েছে শত ব্যর্থতার নিচে।
সাম্প্রতিক ফুটবল র্যাংকিংয়ের দিকে তাকালে আমাদের ফুটবলের অবনমন-ব্যর্থতা খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। আমাদের খুবই কাছের দেশ থাইল্যান্ডের বর্তমান র্যাংকিং ৯৬, ভিয়েতনাম ১১৯, ভারত ১২৫, মালয়েশিয়া ১৩৩, ফিলিপাইন ১৪৫, আফগানিস্তান ১৫১, মালদ্বীপ ১৬৩, নেপাল ১৭৬, ভুটান ১৮২, বাংলাদেশ ১৮৫। পাকিস্তান, শ্রীলংকাই কেবল আমাদের পেছনে পড়ে আছে। আমরা এখনও ভুটানের পেছনে পড়ে আছি এটা তো একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অনেকেরই মনে থাকার কথা, মালদ্বীপ নব্বই দশকে একবার ইরানের কাছে ১৭ গোল খেয়েছিল, অথচ সেই মালদ্বীপ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ফুটবল শক্তি। আমাদের জন্য আরও লজ্জার বিষয় হলো বর্তমানে ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ এবং ভারতের বেশ কিছু ফুটবলার যারা বিভিন্ন দেশের লিগে খেলে থাকে, কিন্তু আমাদের সে রকম কোনো ফুটবল প্রতিভার বিকাশ আমরা ঘটাতে পারিনি।
তাবিথ আউয়াল নতুন সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় নিশ্চিত সবাই-ই খুশি। তাবিথ টগবগে তরুণ। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের ফুটবলের নেতৃত্বে এখন তরুণরাই। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে রয়েছেন তরুণ বাসাম আদিল জলিল। মালদ্বীপের ফুটবল উত্থানে যার অনেক ভূমিকা রয়েছে। নেপালের পঙ্কজ বিক্রম নেমবাংয়ের বয়সও কম। এদিকে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কল্যাণ চৌবের বয়সও খুব বেশি নয়। তার বর্তমান বয়স মাত্র ৪৭। তিনিও রাজনীতিবিদ। বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। লোকসভা ও বিধানসভায় নির্বাচন করে চারবার পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু ভারতের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। তাবিথ আউয়ালও রাজনীতিবিদ। প্রজ্ঞা, মেধায় তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক। ভোট প্রতারণার কবলে না পড়লে তিনি অনেক আগেই উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হতেন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
সালাউদ্দিন যুগে আমরা দেখেছি দেশের ফুটবলের চেয়ে কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে সবাইকে বেশি মাতামাতি করতে। তার অতীত ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতেই সময় পার হয়েছে বেশি। তাবিথ জামানায় সে রকম কিছু হবে না বলেই বিশ্বাস। ফুটবলের উন্নতির জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ, প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। প্রয়োজন রাজধানী থেকে তৃণমূলের মাঠে ফুটবলকে সচল, সজীব, প্রাণময় করে রাখা। আমরা প্রত্যাশা করি তাবিথ সেভাবেই এগোবেন। তরুণ তাবিথের হাত ধরে জেগে উঠুক রঙহীন ফুটবল।
জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক ও গবেষক
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!