ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা
গিয়েছিলেন পেটে গ্যাসজনিত সমস্যা নিয়ে। পরে ফিরতে হয় লাশ হয়ে। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসায় অবহেলায় প্রাণ হারান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাহিব রেজা। ছয় মাসের তদন্তে চিকিৎসায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ও ল্যাব এইড হাসপাতালের অবহেলা, গাফিলতি ও অদক্ষ অবেদনবিদ (অ্যানেসথেসিস্ট) দিয়ে অজ্ঞানসহ গুরুতর ত্রুটি পেয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি।
অবহেলায় এই মৃত্যুর ঘটনার প্রমাণ পেয়ে ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ও তার কর্মরত প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বিএসএমএমইউ) নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অভিযুক্ত চিকিৎসক বিএসএমএমইউয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। তবে সেই নির্দেশনাকে আমলে নেয়নি বিএমডিসি ও বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ রয়েছে- অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. স্বপ্নীল পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি ভুক্তভোগীর পরিবার বিচার দাবিতে আদালতের শরণাপন্ন হলে তাদের হুমকি ও সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ডা. স্বপ্নীলের কাছে যান রাহিব রেজা। এ সময় তাকে এন্ডোসকপি করানোর পরামর্শ দেন ওই চিকিৎসক। ওই দিন সন্ধ্যায় রাহিব হাসপাতালের বহির্বিভাগে অপেক্ষা করেন। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তার পরীক্ষা শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রোগীকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পান রাহিবের পরিবারের সদস্যরা। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ল্যাব এইডের আইসিইউতে নেওয়া হয়। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে রাহিবেকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন:
ডেমরায় এক কক্ষে কিশোরী ও যুবকের মরদেহ
এ ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ করে রাহিবের পরিবার। তাদের অভিযোগ- দায়িত্বরত চিকিৎসক ও তার টিমের গাফিলতির কারণে সাধারণ একটা অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে রাহিবকে। পরে সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনিও বেশকিছু ত্রুটি দেখতে পান। এ ঘটনায় দ্রুত কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশ দেন।
রাহিবের স্ত্রী তাসমিয়া আফরোজ গতকাল রাতে আমাদের সময়কে বলেন, ‘ডা. স্বপ্নীল শুরুতে হাসপাতালে শেখ হাসিনার ভয় দেখান। তার কিছুই করতে পারব না বলে হুঙ্কার দেন। পরে তার লোকজনকে দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ফেক আইডি খোলেন এবং ফোনে হুমকি দেন। তাতেও দমে না যাওয়ায় সমঝোতার প্রস্তাব দেন।’
আদালতে প্রতিবেদন দাখিল হলেও বিচার না পেয়ে গতকাল বুধবার হাইকোর্টে সংবাদ সম্মেলন করে রাহিব রেজার পরিবার। এ সময় ভুক্তভোগীর পরিবারের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, গত ১১ মার্চ রুল জারি করেন আদালত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। ছয় মাস তদন্ত করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে অধিদপ্তরের কমিটি।
আরও পড়ুন:
আফরোজা পারভীন পেলেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার
রাশনা ইমাম আরও বলেন, ‘প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি স্পষ্টীকরণ (ক্লারিফিকেশন) চিঠিও দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যেখানে স্পষ্ট করে ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে গুরুতর অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এন্ডোসকপির প্রক্রিয়া, এন্ডোস্কোপিকালীন এবং পরবর্তী পর্যবেক্ষণে চরম অবহেলা করা হয়েছে। এখানে স্বপ্নীল ও হাসপাতাল উভয়ই সমান অপরাধী।
আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে গত ২৪ জুন ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএমডিসি ও বিএসএমএমইউকে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব ¯েœহাশীষ দাশ স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে সংশ্লিষ্টদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে অবহেলার প্রমাণ পেলেও বিএমডিসি ও বিএসএমএমইউ ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিষয়টি দেখে ব্যবস্থা নেব।’ অন্যদিকে বিএসএমএমইউয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. আবদুল হান্নান আমাদের সময়কে বলেন, ‘ব্যব্যস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়েছি। পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। এর পরই তো আন্দোলন শুরু হয়। আমরা চলে এসেছি। পরে কী হয়েছে জানি না।’
আরও পড়ুন:
ডেঙ্গুতে একদিনে ৬ জনের মৃত্যু ভর্তি ৬৪৫
হেপাটোলজিস্টরা বলছেন, একজন চিকিৎসক স্টান্ডার্ট মেনে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকলে দিনে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০টি এন্ডোসকপি করতে পারেন। রাহিবের ঘটনার পর ল্যাব এইড হাসপাতালে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক দিনে সর্বোচ্চ ৭২টি এন্ডোসকপি করার তথ্য পান। যার সবগুলোতে নেতৃত্ব দেন ডা. স্বপ্নীল। যা দেখে তিনি রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং পরে এ ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন।
রাহিবের মৃত্যুতে অবহেলা প্রমাণ হওয়ায় ডা. স্বপ্নীলের স্থায়ীভাবে নিবন্ধন বাতিল চায় রাহিবের পরিবার। তার আইনজীবী বলেন, ‘এখন আমরা হাইকোর্টে ডা. স্বপ্নীলের নিবন্ধন বাতিল, ল্যাব এইডের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা এবং ক্ষতিপূরণের আবেদন জানাব।’