দ্রব্যমূল্যের চাবুক সাধারণ মানুষের পিঠে

মাহফুজুর রহমান
২০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দ্রব্যমূল্যের চাবুক সাধারণ মানুষের পিঠে

বাজেট, ফিসক্যাল পলিসি, মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি, নীতি সুদহারÑ অর্থনীতির এসব টার্মকে পাশ কাটিয়ে দ্রব্যমূল্য এবার হানা দিয়েছে ভোক্তাদের পকেটের তলানিতে। প্রতিদিন সকালেই দেশের সব পর্যায়ের সাধারণ মানুষ টের পাচ্ছে যে, পণ্যমূল্য লাগামহীন হয়ে ছুটছে। এ প্রসঙ্গে পল্লীকবি জসীমউদ্্দীনের একটি বক্তৃতার কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ঢাকায় একটি বক্তৃতায় তিনি কাগজের দাম নিয়ে কথা বলেছিলেন। পল্লীকবি বলেন, ‘আমি কাগজের দাম নিয়ে আর কথা বলব না। স্বাধীনতার আগে কাগজ বিক্রি হতো চার আনা দিস্তা। স্বাধীনতার পর বেড়ে হয়েছে আট আনা। এ নিয়ে আমি বক্তৃতা দিলামÑ কাগজের দাম এভাবে বাড়লে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরাই বা কিসের ওপর কবিতা লিখব? বক্তৃতার পরদিন কাগজ হয়ে গেল ১০ আনা। আবার বক্তৃতা দিলাম, কাগজের দাম কমান। কাগজের দাম হয়ে গেল ১২ আনা। প্রতিবাদে আমরা নীরব মিছিল করলাম। কাগজের দাম হয়ে গেল ১৪ আনা। এবার আমি ক্ষমা চাই, কাগজ নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। কথা বলতে গেলেই কাগজের দাম বেড়ে ১ টাকা দিস্তা হয়ে যাবে।’

বিগত সরকারের আমলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সবাই সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছিল। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। তা হলে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যাবে। পত্রপত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাণিজ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায়। আমিও বিষয়টি নিয়ে কলাম লিখে এর প্রতিবাদ করেছিলাম। এখন টিপু মুনশি নেই, আগের সরকারও নেই। কিন্তু পণ্যমূল্য লাফাচ্ছে।

গত রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে কাঁচামরিচ কিনে এনেছিলাম ৪০০ টাকা কেজিদরে। একটি মরিচের দাম পড়েছিল ৪ টাকা। মরিচের বোঁটা বাদ দিয়ে হিসাব করলে দাম আরও বেশি দাঁড়াবে। ঘুম থেকে উঠে বাজারে গিয়ে দেখি কাঁচামরিচের দাম হয়েছে ৮০০ টাকা কেজি। অর্থাৎ একটি মরিচের দাম ৮ টাকা। আজ হয়তো চোখে আর ঘুমই আসবে না। এই ভরসায় বলা যেতে পারে যে, আগামী ভোরে কাঁচামরিচের দাম বাড়বে না। তবে এর দাম আগামীকাল যদি আরও বেড়ে যায়, দোকানি মামুন যদি লাজুক লাজুক হাসিমুখ নিয়ে বলেÑ আজ মরিচের দাম ১৬শ টাকা কেজি স্যার, তা হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

সোনার দাম বেড়েছে, আমরা সোনা কিনব না। টেলিভিশনের দাম বেড়েছে, আমরা পুরনো টিভি দিয়েই আরও কিছুকাল চালিয়ে নেব, জুতোর দাম বেড়েছে, আমরা খালিপায়ে ঘুরে বেড়াব। কিন্তু প্রতিদিন সকালে তো আমাদের দাঁড়াতে হয় সবজির দোকানে। উচ্চবিত্তদের কথা আলাদা, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনে অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। পকেটে যথেষ্ট টাকা নেই, কিন্তু বেগুন-পটোল-আলু কিনতে হবে। বাকি আর কর্জ পরিহার করে স্বচ্ছ জীবন ধারণ হবে কীভাবে?

পথে চাঁদাবাজি হচ্ছে, তেলের দাম বেড়েছে, বন্যার জন্য সবজির জমি নষ্ট হয়েছে, পুজোর সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেশি করে সবজি খেতে হয় বলে দাম বেড়েছে, ফ্যাসিবাদী সরকারের লোকজন গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেÑ এসব সস্তা বুলি কেউ ছড়াতে চাইতেই পারেন। কিন্তু এসব কথা বর্তমানে আর বাজারে বিকোবে না। কারও পেটে যখন খিদে বিদ্যমান, পেটে যখন জ্বলছে খিদের আগুন, তখন ‘পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ১০০ কারণ’ শীর্ষক চিনিমাখা কথাও কানে ঢুকবে না।

সম্প্রতি পণ্যমূল্য বিষয়ে সৌম্যকান্ত চেহারার সফেদ পোশাক পরা একজন শ্রদ্ধাভাজন মানুষের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আমার অচেনা এই ভদ্রলোক জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কথা বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি বলছেন, আমরা হয়তো না খেয়েই মরে যাব। তার এই কান্না দেখে আমার চোখে পানি এসেছে, বুকটা এখনও ভার হয়ে আছে। এ ধরনের ভদ্রলোকরা কারও কাছে হাত পাততে পারবেন না, পেটের খিদে গোপন রেখেই জীবনের শেষ দিনগুলো পার করবেন। জাতির জন্য কী লজ্জা! আমরা আমাদের অসহায় সিনিয়র মানুষদের পাতে সামান্য খাবারটুকুও দিতে পারব না।

সরকারি চাকরি সমাপনান্তে অবসরজীবী মানুষ আছেন মহাকষ্টে। তাদের পেনশনের পরিমাণ সীমিত। এই সীমিত আয়ে পরিবারের চিকিৎসা খরচসহ ভরণপোষণের ব্যয় সামলানো এক কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ বলে যে প্রবাদ বাক্যটি চালু আছে সেটি সম্ভবত অবসরজীবী পেনশনভোগীদের বেলায় অধিকতর প্রযোজ্য। চাকরি শেষে যারা পেনশন না নিয়ে পুরো টাকা একসঙ্গে গ্রহণ করেছেন তারা মাসিক পেনশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত আছেন। এভাবে অবসর গ্রহণকালে পুরো টাকা গ্রহণকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে বা ছেলেমেয়েদের ব্যবসা, চাকরি, বিয়ে, বিদেশ গমন ইত্যাদি খাতে প্রাপ্ত টাকা ব্যয় করে নিঃস্ব হয়েছেন বিবেচনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রস্তাব অনুসারে সরকার এই মর্মে অনুমোদন প্রদান করে যে, অবসর গ্রহণের ১৫ বছর পর থেকে শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা পেনশন পাবেন। অবসর গ্রহণকারীদের এই গ্রুপ তাদের অভাব-অভিযোগের কথা তুলে ধরে বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাদের অনুকূলে পেনশন চালুর সময়সীমা ১৫ বছরের বদলে ৮ বা ১০ বছরে কমিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছে। সমাজে চরম অবহেলায় দিনাতিপাত করা এই অবসরজীবীদের আবেদন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। বর্তমান সময়ে দৈনিক ভিত্তিতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় এদের জীবনও অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে।

বাজারে টিপু মুনশি বর্ণিত অপ্রতিরোধ্য সিন্ডিকেটের গলায় এবার দড়ি পরবে ভেবে সাধারণ মানুষ কয়েকদিন উচ্ছ্বসিত থাকলেও দিনে দিনে এই উচ্ছ্বাস নিভে আসছে। মানুষ জানে না আগামীকাল ঝিঙ্গার কেজি কত টাকা হবে? ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচ কত টাকা হবে? ২০ টাকার ধনেপাতা কিনতে চাইলে দোকানদার ঢিল দিয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবে কিনা?

বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা বহাল রাখতে হলে দ্রুত যেমন করেই হোক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে হবে। বাণিজ্য উপদেষ্টা কাঁচাবাজার পরিদর্শনে গেলেন কিনা, টেলিভিশনে তাকে দেখানো হলো কিনা, বাজারে কতজনকে জরিমানা করা হলো, এসব বিবেচনা করে মানুষ ধৈর্য ধরবে না। তা ছাড়া বাজার পরিদর্শনের মাধ্যমে পণ্যমূল্য কমানো যাবে না। পণ্যের মূল্য কমাতে হলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ঘরে ঘরে খালি জায়গায় সবজি চাষের আয়োজন করতে হবে। কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে এবং উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের বেলায়ও সরকারি উদ্যোগ কাজে লাগানো যেতে পারে। ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং সরকারি সহায়তায় সহজে মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কমিয়ে কম মূল্যে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

তবে আমি পণ্যমূল্য কমানোর কথা বলছি না। আমি লক্ষ করেছি, পত্রপত্রিকায় পণ্যমূল্যের বিষয়ে কোনো রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর এর দাম আরও বাড়ে। এই দাম বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ বিদ্যমান থাকে। সিন্ডিকেট, চাঁদাবজি থেকে শুরু করে বন্যা, কম উৎপাদন, অতিরিক্ত মুনাফা লোভ ইত্যাদি নানা কারণে দাম বাড়ে। এ ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য কম রাখার বিষয়ে সরকারের আপসহীনতা এবং প্রয়োজনবোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর ব্যবস্থাপনা পণ্যমূল্য ন্যায্য সীমার ভেতর আটকে রাখে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এসব ক্ষেত্রে নীতিকথার ধারেকাছে কখনোই যাননি, এখনও যাবেন নাÑ এটা অনুধাবন করার জন্য ক্ষমতায় যেতে হয় না। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টারা বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছেন পণ্যমূল্য কম রাখার জন্য, এতে পণ্যমূল্য আরও বাড়বে। কারণ বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদের সুস্পষ্ট ধারণা হবে যে, সরকারের কোনো প্রায়োগিক শক্তি নেই, তারা কেবল বাণীদাতামাত্র। প্রয়োজনেও তারা কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। বর্তমান অবস্থাটা সম্ভবত সে রকমই চলছে। তাই আমি পণ্যমূল্য নিয়ে কিছু লিখতে চাই না। পল্লীকবি জসীমউদ্্দীনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিষয়টির এখানেই ইতি টানতে চাই। নইলে কিন্তু পণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।


মাহফুজুর রহমান : প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক