শিরোপা ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারী ফুটবলাররা সমষ্টিগতভাবে অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতার বিপক্ষে লড়াই করে যেভাবে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিপ্লব ঘটিয়েছেন এটি অনন্য এবং অসাধারণ। নারীরা ফুটবল চত্বরে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন আত্মবিশ^াস, সাহস এবং ইচ্ছাশক্তির বদৌলতে! তারা হারতে চাননি।
আর এই মানসিকতাই স্বপ্নপূরণে সাহায্য করেছে! অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তারা হয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনে অনুপ্রেরণার উৎস। নারী ফুটবলাররা দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে পিছিয়ে রাখা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা প্রতিরোধের শক্ত বেড়া ভেঙে আলোকিত স্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠা এবং অধিকার আদায় করা সম্ভব।
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নারী খেলোয়াড়রা যেভাবে তাদের বিরুদ্ধাচারকারীদের সনাতনী ভুল ভেঙে দেশের জন্য কিছু করে তাদের মন জয় এবং সমর্থন আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছেনÑ এই বিষয়টিকে সামাজিক বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা রাষ্ট্রীয় জীবনে নতুন উপলব্ধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের বক্তব্য, মানুষ পরিবর্তন চায় সেটি খুব তাড়াতাড়ি বা পরে। আর এই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সবসময় সমষ্টিগত উদ্যোগ এবং দৃঢ় মানসিকতা।
এক সময় যা ভাবতে পারিনি- ক্রীড়াঙ্গনে যেন সেটাই দেখেছি। ২০২২ সালে যখন বাংলাদেশ নারীদল নেপালে স্বাগতিকদের ৩-১ গোলে পরাজিত করে সাউথ এশিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে সেরা নারীদল হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করে, সে দিন আবার বড় বেশি মনে হয়েছে বাঙালির জন্য স্বাধীনতার কত বেশি প্রয়োজন ছিল! স্বাধীনতার আগে পুরুষদের মতো নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রাখার সুযোগ ছিল না। নারীদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ায় নারীরা তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পেয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনে। ক্রীড়াঙ্গনে ইতিবাচক অবদান রেখে এগিয়ে চলেছেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বয়সভিত্তিক ফুটবলে নারীরা পুরুষ ফুটবলারদের অনেক আগেই পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন। নারীরা যে পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতে দেশের জন্য বারবার সাফল্য এনে দিচ্ছেন, বিশেষ করে বয়সভিত্তিক ফুটবলে এই গল্প শুধু অবিশ্বাস্য নয়, রোমাঞ্চকরও।
মানুষ এখন বিশ^াস করে নারী ফুটবলাররা যদি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে যথাযথ প্রটেকশন এবং পৃষ্ঠপোষকতা পান, তাহলে ফুটবলে আসিয়ান অঞ্চলে একটি ভালো দল হিসেবে পরিচিত হতে বেশি সময় লাগবে না। নারী ফুটবলের ক্ষেত্রে সমস্যা এবং এর সমাধানের বিষয়টি অজানা নয়। এটি চ্যালেঞ্জ, আর এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা সম্ভব সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে। পেশাদারির বিকল্প নেই, তা সে খেলার মাঠে, সংগঠনে বা প্রশিক্ষণে! এই বিষয়টিতে আমাদের ক্রীড়াঙ্গন পিছিয়ে আছে। একটু নজর করলে বুঝতে পারবেন আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে ব্যবস্থাপনা এবং পরিষেবা দুর্বল! সমষ্টি মানুষের সচেতনতা এবং উত্থান দরকার ক্রীড়াঙ্গনে। ক্রীড়াঙ্গনের অন্তর্গত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। অভাবনীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফুটবল চত্বরে অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা এবং সংকট এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ১৭-৩০ অক্টোবর কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সপ্তম নারী ফুটবল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ নারীদল শিরোপা ধরে রাখার লড়াইয়ে নামবে। বাংলাদেশের নারীদল বর্তমান পরিস্থিতিতে যে অবস্থায় আছেÑ এতে করে বাস্তবতা হলো শিরোপা ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত দুই বছর ধরে নারী ফুটবল বিভিন্ন কারণে মোটেই গোছানো ছিল না।
সপ্তম নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেবে সাতটি দেশ। ‘এ’ গ্রুপে আছে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান। ‘বি’ গ্রুপে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপাল। বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ খেলতে নামবে ২০ অক্টোবর পাকিস্তানের বিপক্ষে। এরপর ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ খেলবে ভারতের বিপক্ষে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম শিরোপা সাবিনা খাতুনরা জিতেছিলেন নিয়মিত কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের হাত ধরে। যিনি দীর্ঘ সময় ধরে খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যিনি প্রত্যেকের সামর্থ্য ও মন-মানসিকতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। প্রেক্ষাপট পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সাবিনাদের এখন নতুন কোচ ইংল্যান্ডের পিটার বাটলার। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে বিদেশি কোচ পিটার বাটলার কিন্তু দেশি কোচ গোলাম রাব্বানীর সঠিক রিপ্লেসমেন্ট হতে পারেননি!
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
যে কোনো দলের জন্য কোচের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কোচ তো দলকে বিভিন্নভাবে গাইড করেন। লড়াইয়ের জন্য উজ্জীবিত করেন। খেলাধুলার সঙ্গে মানসিক বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জড়িত। সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইংলিশ কোচ পিটার বাটলার বলেছেন, ‘যেভাবে আশা করেছিলাম সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা। ম্যাচ খেলার সুযোগ না পেলেও মেয়েরা প্রস্তুতিতে খুবই ভালো করেছে। নিজেদের মধ্যে ম্যাচ খেলেই আমরা অনুশীলন সেশন করেছি।’ তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘দুই বছর আগের দল নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি পেছনে ফিরে তাকাতে পছন্দ করি না। আমার হাতে যারা আছেন তাদের নিয়ে পরিকল্পনা করেছি। সর্বশেষ আসরে বাংলাদেশ শিরোপা জিতেছিল এটা গর্বের ব্যাপার। এখন সেটা মাথায় রাখলে চাপ বাড়াটা স্বাভাবিক। যেটা হয়ে গেছে সেটা তো শেষ, অতীত হয়ে গেছে সেটা। আপনাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
দেশের ফুটবল অনুরাগীদের দৃষ্টি এখন সপ্তম নারী সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপকে ঘিরে নিবদ্ধ। পুরুষদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশে দল শেষবারের মতো কখন শিরোপা জিতেছিল এটা বর্তমান প্রজন্ম ভুলে গেছে। সবাই নারী ফুটবলারদের দিকে এখন আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন। নারীদল গত আসরে (২০২২) চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হয়েছে। কথা একটি, ফুটবল দলীয় খেলা। সবাই মিলে শতভাগ সামর্থ্য উজাড় করে খেলতে হয়। পাশাপাশি প্রয়োজন হয় ভাগ্যের সহায়তার।
ইকরামউজ্জমান : কলাম লেখক ও বিশ্লেষক
সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এআইসিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!