নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা : প্রতিকার কী?

মৌলি আজাদ
১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা : প্রতিকার কী?

একটি জাতীয় দৈনিকের ১ অক্টোবর সংখ্যায় একটা রিপোর্ট পড়লাম। রিপোর্ট বলছে- মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন বা এমএসএফ জানিয়েছে, চলতি বছর সেপ্টেম্বরে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা আগস্টের তুলনায় অনেকাংশে বেড়েছে, যা উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বরে ২০৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, যা আগের মাসের তুলনায় ৭০টি বেশি। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৩৫টি। দলবদ্ধ ধর্ষণ ১১টি; ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা রয়েছে দুটি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে পাঁচ প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের রিপোর্ট বলছে, সেপ্টেম্বরে ১৮৬ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১ জন। ১১ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তিন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১১ জন কন্যাসহ ১২ জন। এর মধ্যে চার কন্যা উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে। বিভিন্ন কারণে ১০ জন কন্যাসহ ৪৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া একজনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। সাত কন্যাসহ ২৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে তিনজন। এর মধ্যে এসিডদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে একজনের। এক কন্যাসহ তিনজন অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে অগ্নিদগ্ধ হয়ে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে দুজন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক কন্যাসহ ১৬ জন। পারিবারিক সহিংসতায় শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে দুটি। এক গৃহকর্মীকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ কন্যাসহ ১৪ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তিন কন্যা অপহরণের শিকার হয়েছে।

অর্থাৎ দেশে ক্রমান্বয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। দেশের যে কোনো বিশেষ সময়ে দেখা যায়, নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এটা শুধু আমাদের মতো দেশে নয় উন্নত দেশগুলোতেও হয়। নারী ও শিশু অসহায় বলেই এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে। যারা ঘটায় তারা জানেন, তাদের টিকিটাও কেউ ধরতে পারবে না। তারা নারী ও শিশুকে দমিয়ে রাখতে পারঙ্গম। তাই তারা আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক অপরাধ করে যায়।

হঠাৎ নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন বাড়ছে কেন?

আমাদের দেশের নারীরা এমনিতেই থানা পুলিশ এড়িয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বর্তমানে আমরা জানি, অনেক থানায় পর্যাপ্ত পুলিশ নেই। তাই নারী ও শিশুরা থানায় যাবে কী যাবে না এই নিয়ে দোটানায় ভোগেন।

বর্তমানে অনেক নারীকে পুরুষরা থানায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বিপদে পড়বে বলে ভয়ভীতি দেখায়। যার ফলে নারী চুপ থাকে।

যত্রতত্র এসিড পাওয়ার কথা নয়, হয়তো দেশের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে অনেক দুর্বৃত্তের কাছে এসিড কেনা সহজ হয়ে গেছে যা অত্যন্ত অনাকাক্সিক্ষত।

নারীকে এই সময়ে দুর্বল পেয়ে অনেক নিকৃষ্ট স্বামীই যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছেন এবং আকাক্সিক্ষত যৌতুক না পেলে ভয়াবহ নির্যাতন করছেন।

বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগে ধর্ষণ ক্রমাগত বাড়ছে। দুঃখের বিষয় যে, এর শিকার থেকে বাদ যাচ্ছেন না প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরীরা।

আত্মহত্যার ঘটনা অনেক ঘটছে। এটা আত্মহত্যা না হত্যা তা সঠিকভাবে নিরূপণ হচ্ছে কিনা- জানা নেই।

অপহরণের মতো ঘটনাতো রীতিমত উদ্বেগজনক।

গৃহকর্মীরা অসহায় বিধায় তারা এ সময়ে কোনোদিকে কূল করতে পারছে না। তাদের অবস্থা রীতিমত শোচনীয়।

প্রতিকার : যে কোনো অবস্থানের নারীকে তার প্রতি সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে মুখ খুলতে হবে।

নির্যাতনের শিকার হলে থানায় গিয়ে পুলিশকে অবহিত করতে হবে। প্রয়োজনে কোর্টে যেতে হবে। থানা পুলিশ নারীর যে কোনো সমস্যায় অবশ্যই এগিয়ে আসবে। তাই খামোখা পীড়নের শিকার হয়ে কোনো লাভ নেই।

নারীকে তার অধিকার ও দেশের প্রচলিত আইনগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা রাখতে হবে।

নারীকে রাস্তাঘাটে আত্মরক্ষার্থে সতর্কভাবে চলাচল করতে হবে। নারীকে ৯৯৯-এর সাহায্য নিতে হবে। নারীর জানা দরকার বাংলাদেশ পুলিশের সেবাগুলোর মধ্যে ৯৯৯ জনগণের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। ইতোমধ্যে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর রেসপন্স টাইম আরও কমিয়ে অতি দ্রুত সেবাগ্রহীতার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সুতরাং নারীর বিপদে ৯৯৯ হতে পারে বিরাট হাতিয়ার। ঘরে বসে অহেতুক মার না খেয়ে ৯৯৯-এর সুযোগ নিন।

বাসে/লোকাল প্লেসে যৌন নিপীড়নের শিকারের আশঙ্কা বোধ করলে বাসে উঠেই নারীর উচিত বাসের নম্বরটা টুকে রাখা এবং প্রয়োজনে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেবা ১০৯-এর দ্বারস্থ হওয়া।

দীর্ঘ বিরতির পর দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস শুরু হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ওপর ক্লাস বিরতির কারণে ট্রমার সৃষ্টি হতে পারে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাউন্সিলিং জোরদার করতে হবে।

আজকাল বেশিরভাগ নারী শিক্ষক/শিক্ষার্থী/কর্মকর্তা সাইবার ক্রাইমের শিকার হন, তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটিগুলো এ সময়ে বেশি শিক্ষার্থীদের পাশে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

নারী কিন্তু এক কথায় দশভুজা। নারী জীবন সৃষ্টিকারী। তাহলে নারীর ভয় কেন? কাপুরুষের হাতে পড়ে পড়ে মার খাওয়ার জন্য নারীর জন্ম হয়নি। নারীকে উঠে দাঁড়াতে হবে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেবা নেওয়ার অধিকার আছে তার। সেটা তার মগজে ধারণ করতে হবে। তবেই সে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে। তবেই দিন দিন নারীর ওপর নির্যাতন কমে আসবে। জাগো নারী জাগো।


মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক