এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার বিপদ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
১১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার বিপদ

এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার বিপদ অনেক। মাছের মাথায় পচন ধরলে ওই মাছ শেষ। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় এক ব্যক্তিই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক হলে সমূহ বিপদের সময় সবাইকে একসঙ্গে ডুবতে হয়। বিষয়টা বিস্ময়কর মনে হলেও দুর্নীতির সংজ্ঞা সন্ধানেও দুর্নীতি হতে পারে। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক ব্যক্তির কাছে যে ব্যাখ্যা নিজের মনঃপুত নয়, যে বয়ান নিজের ভেদ-বুদ্ধি জ্ঞানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, যে বর্ণনায় নিজের ধ্যান-ধারণারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় না সংজ্ঞায়নে-সুকৌশলে তা এড়িয়ে চলাতেই সংঘটিত হলে তা তুল্য হয় মহা দুর্নীতি (grand corruption)’র সঙ্গে। চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। যে কর্মকাণ্ড নৈতিকতা-বিবর্জিত, সুশাসন, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা যেখানে যবুথবু অবস্থায়, যা সম্পাদনের দ্বারা অন্যের মৌলিক অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়- তা যদি আসে মাথা থেকে গোটা শরীরের জন্য তা সৃষ্টি করে মহা দুর্গতি। সুতরাং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (কজ অ্যান্ড ইফেক্ট) উভয়ের মধ্যেই দুর্নীতির উপস্থিতি লক্ষণীয়। চিন্তা-ভাবনায়, পরিকল্পনায়, সম্পাদনে, ফলাফলে প্রতিক্রিয়ায় সর্বত্র ন্যায়-নীতি নির্ভরতার অনুপস্থিতির মধ্যেই দুর্নীতির আদি অকৃত্রিম অধিবাস। দুর্নীতি শুধু দৃশ্যমান অন্যায় অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, তহবিল তছরুপ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সম্পদের অপচয়, প্রতারণায় সীমাবদ্ধ নয়- দুর্নীতির ষড়যন্ত্রকেও দুর্নীতির এখতিয়ারভুক্ত করার বিধান রয়েছে। যে পরিবেশে দুর্নীতি সংঘটিত হয়ে থাকে সেই পরিবেশকে এবং সেই পরিবেশ সৃজনকারীকেও দুর্নীতির এজাহারভুক্ত করা যেতে পারে। সুতরাং নীতি ও নৈতিকতার অভাবে ভৌত ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি, অপচয়, অপব্যয়, আত্মসাৎ তছরুপ, চিন্তাকর্মে ধ্যানে-জ্ঞানে অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ সবই দুর্নীতি। দুর্নীতির ব্যুৎপত্তিগত বিস্তার ব্যাপক- যেমন প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার, প্রচলিত নৈতিক ধ্যান-ধারণাকে এড়িয়ে চলা, মানসিকভাবে প্রতিবন্ধিত্ব বরণ, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাব, চিন্তা-ভাবনায় একদেশদর্শিতা, অসদাচরণ, অসততা, অসাধুতা, অমিতাচার, অনুচিত, অশোভন, অসমীচীন, অন্যায়, দলীয়করণ ও পক্ষভুক্তকরণ, নিষ্ঠুর আচরণ, ন্যায়বিরুদ্ধতা- সবই দুর্নীতির সংসারে শরিকানাভুক্ত।

নৈতিকতার শক্তিকে সাহস জোগাতে, প্রবল করতে যুগে যুগে ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, আইন-কানুন, নানান উপায় ও উপলক্ষ নির্মাণ করে চলেছে। আইনের শাসন, বিবেকের আদালত, সুশাসন ও জবাবদিহিতার সুস্থ পরিবেশের প্রভাব যেখানে বেশি সজ্ঞান-সক্রিয়, সেখানে দুর্নীতি কম। আবার যেখানে পরিস্থিতি ভিন্ন সেখানে দুর্নীতি বেশি। বর্তমান বিশ্বে যেসব দেশে ও অঞ্চলে সরকারি সম্পদ-সম্পত্তি-সৌভাগ্য ‘ভাগাভাগির’ অর্থনীতি, ‘আত্মসাৎ অপব্যয়ের’ অর্থনীতি-আর্থিকসহ নানান, রাজনৈতিক উৎকোচের ‘কেলেঙ্কারীর’ অর্থনীতি যুগপৎভাবে বেগবান ও বিদ্যমান সেসব সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বিষবাষ্প বা দুর্নীতির দুষ্টচক্র নানান পরিচয়ে পরিব্যাপ্ত। আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটছে এর সামাজিক বিস্তার।

‘জনগণের জন্য’, ‘জনগণের দ্বারা’ নির্বাচিত ‘জনগণের সরকার’ এ জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্রেও এটিই সাফ কথা। এ নীতিবাক্যের আলোকে জনগণের সম্পদ, দেশ ও অর্থনীতির সার্বভৌমত্বসহ সব স্বার্থ, নিরাপত্তা ও অধিকার, ক্ষমতা সবই সংরক্ষণের দায়িত্ব যেমন সরকারের ওপর বর্তায় তেমনি দায়িত্বশীল আচরণের দায়দায়িত্বও জনগণের। নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি দলীয় সরকার প্রধান দলমত নির্বিশেষে সব পক্ষের হয়ে যায়, ‘কোনো প্রকার রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী’ হয়ে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করার শপথ সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে যায়। সেই শপথের ব্যত্যয়ে সব জনগণের সম্পদ ও স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব পালনে অপারগ পরিবেশ পরিস্থিতিতে সরকার প্রধান নিজেই রক্ষক থেকে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে সে পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের মৌলিক মর্মমূলে আসে আঘাত। সাম্প্রতিক বিশ্বে কয়েকটি ছোট-বড় দেশে, অঞ্চলে ও অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নির্বাচিত কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকার। এসব সরকার নিজেই কলাকৌশলে দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চলে গেছে। আমজনতার অর্থনীতিতে ভাগ বসিয়েছে আত্মসাতে উন্মুখ দুর্নীতিবাজ নীতিনির্ধারক, জনগণের ভাগ্য বিধায়ক সরকার। তাদের সাফল্যসমূহ ম্লান হয়ে গেছে সীমাহীন দুর্নীতিতে, সেখানে ব্যাহত হয়েছে উন্নয়ন আর নানান নেতিবাচক মনোভাব এসে চিড় ধরিয়েছে জনগণের আস্থায়। এমন পরিস্থিতিতে কোথাও কোথাও উদ্ভব হয়েছে ভিন্ন পথ ও পন্থার। দেখা গেছে যতগুলো কারণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পথ ও পন্থার সরকারের পতন বা পরিবর্তন ঘটেছে তাদের দুর্নীতি বরাবরই শীর্ষ কারণ হিসেবে সামনে এসেছে।

দুর্নীতি নানান উপায়ে, প্রকারে ও ক্ষেত্রে হতে পারে। ছোট-খাটো ব্যাপারে অন্যায় অনিয়মকে না দেখার ভান করে প্রশ্রয় দিয়ে, সামান্য পারিতোষিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে, দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতার দ্বারা পুচকে প্রকৃতির দুর্নীতি (petty corruption) হয়ে থাকে, আর ব্যাপক আকারে বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা অর্থের, আত্মসাৎ অবৈধ অর্জন কিংবা তছরুপের দ্বারা মহা দুর্নীতি (grand corruption) সম্পাদিত হয়ে থাকে। আর সময় ও সমাজে নানান নিয়ম-কানুনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যে দুর্নীতি তা পদ্ধতিগত দুর্নীতি (systematic corruption)। বিশ্বাস, ধারণা চিন্তা-চেতনায় দূরভিসন্ধি এঁটে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিত্ব বরণ করে যে দুর্নীতি তা নৈতিক দুর্নীতি (moral corruption) সালিশ বা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে যে দুর্নীতি তা আইনের দুর্নীতি (legal corruption)। এ ধরনের দুর্নীতির মধ্যে আছে আন্তঃসংযোগ, রয়েছে পরস্পর প্রযুক্ততাও।

অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ কষ্টার্জিত নয়। কোনো সম্পদ সৃষ্টি কিংবা বা সেবার বিনিময়ে এটি অর্জিত হয় না বিধায় এই টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও চাহিদা সরবরাহ উপযোগিতা বাছবিচার চলে না বলেই এই অর্থ অবাধ খরচের ফলে মূল্যবৃদ্ধির কারণ ঘটিয়েও আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যে ব্যত্যয় ঘটিয়ে থাকে। সমাজে অবৈধ আয়ের অর্থ অধিক ব্যয়ের চাকচিক্য সীমিত আয়ের মানুষদের কাছে দুঃসহ যন্ত্রণা ও মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতে অবৈধতার প্রতিযোগিতার পরিবেশে খেসারত দিতে হয় নীতি ও নৈতিকতার মূল্যবোধকেই। এক সময় হাতে গোনা গুটিকয়েক লোক হয়তো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হতো, সংখ্যাগুরু নীতিবানরা সবাই তাদের ঘৃণা করত, কিন্তু ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিবাজের মিছিল বড় হয়ে নীতিবানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে ‘Bad money drives away good money from the market’- এই থিউরিতে পরিস্থিতি এমনভাবে মোড় নিতে পারে যে নীতি ও নৈতিকতা এক ঘরে হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে, একটি দপ্তরে সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা কর্মসম্পাদন প্রক্রিয়ায় যারা থাকেন তারা সবাই উপরির অর্থ সমানভাবে নিতে বা পেতে বাধ্য হন। এ ধরনের পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে দশের চক্রে ভগবানকে ভূত বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সমাজে ভালো বা নিরপেক্ষ লোকের জন্য দারুণ দুঃসংবাদ এটি। আমলা বলি আর সুশীল সমাজ বলি, বুদ্ধিজীবী বলি আর পেশাজীবী বলি সব ক্ষেত্রে এভাবে দলীয়করণ বা পক্ষভুক্তকরণের মহড়া চলতে থাকায় দল ও মত নিরপেক্ষদের বিড়ম্বনা বাড়তেই থাকে। এমন পরিবেশে দেখা যাবে আমলারা অধিকমাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে পড়ছেন আর রাজনীতিতে নীতি-নির্ধারকরা আমলার মতো আচরণে নিষ্ঠাবান হতে চলেছেন। অর্থাৎ যার যা করণীয় তা তিনি করছেন না, যার যা হওয়া উচিত নয় তিনি তাইই হচ্ছেন। কেউ স্বেচ্ছায় কেউবা বাধ্য হয়েই হচ্ছেন। এ সবই একইভাবে দুর্নীতির নিয়ামক এবং দুর্নীতির প্রতিফলও বটে। এমতাবস্থায় সমাজে বা পরিবেশে এখন দুর্নীতি এড়িয়ে চলায় ঝুঁকি বাড়ে এবং এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়া দেশ ও সমাজে বেশ হলাহলপূর্ণ পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে থাকে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়- কারও কোনো কাজে বাড়তি খরচের এবং নিজেকে বাধ্যতামূলকভাবে দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে ফেলার পরিবেশ তৈরি হয়। এভাবে সমাজের মধ্যকার সৃজিত বৈষম্য উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলীয়করণ, পক্ষভুক্তকরণের অস্বচ্ছ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতার বিড়ম্বনা বিপত্তি বাড়তেই থাকে। সভ্যতার সংকট শুরু হয় এভাবেই।

দুর্নীতি ‘দমন’ কার্যক্রম মূলত দুর্নীতি হওয়ার পর তার কারণ অনুসন্ধান ও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের কার্যক্রমকে নির্দেশ করে। এটি পোস্ট মর্টেম প্রকৃতির পদক্ষেপ। দুর্নীতি দমনে দুর্নীতির প্রতিরোধের পরোক্ষ প্রেরণা বা সুযোগ বাঞ্ছিত হলেও যথাসময়ে যথাযথ ‘দমন’ কার্যক্রমে অপারগতা বা বিলম্ব বা পক্ষপাতিত্বসুলভ ভিন্নতা দুর্নীতি এড়িয়ে চলার স্থলে অধিক হারে দুর্নীতি করার পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। দুর্নীতি দমন সংস্থার নিজস্ব স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, দক্ষতা, প্রয়োগ কুশলতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে দুর্নীতি দমন দ্বিধান্বিত হতে পারে। দুর্নীতি হওয়ার পর শুধু নয়, দুর্নীতির উৎসমূলে প্রতিরোধের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। কীভাবে, কেন দুর্নীতি হচ্ছে কোন কোন অনুষঙ্গ এর জন্য দায়ী সেসব সমস্যাকে চিহ্নিত করে উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত প্রতিবিধান প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের বলিষ্ঠ বিকাশে এবং এ ব্যাপারে নীতি-নির্ধারককে সহায়তার ক্ষেত্রে সমাজ উন্নয়ন বীক্ষণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার ভূমিকা অগ্রগণ্য। বন্যা হলে পর বাঁধ দেওয়ার কথা ভাবার চেয়ে বন্যার উৎস অনুসন্ধান এবং সেখানকার শুদ্ধিকরণ অগ্রাধিকারে আসা উচিত। সুতরাং দমনের চেয়ে নিয়ন্ত্রণে, নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রতিরোধে, প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিশোধনে বিশেষ মনোযোগ ও বিবেচনায় আনা আবশ্যক হবে দুর্নীতি প্রশমন প্রয়াসে।

সবার স্বার্থেই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সবারই সচেষ্ট হওয়া উচিত। দুর্নীতির করালগ্রাসে অর্থনীতি, সমাজ, সংসার দেশ- সবখানে কলুষিত হতে পারে, দেশ ও চরিত্রের সুনাম নষ্ট হলে তার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া সবাইকে ভোগ করতে হয়। সুতরাং নিজে ‘ভালো’ থাকলেই যথেষ্ট নয়, অন্যরা মন্দ হলে নিজের ভালত্ব চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে কতক্ষণ।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান