আওয়াজ তোলা চাই - ‘তামাক পণ্যে না’

ড. আতিউর রহমান
২২ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আওয়াজ তোলা চাই - ‘তামাক পণ্যে না’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৪ সালে তামাক পণ্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন তৈরি করে। এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাকদ্রব্যের ব্যবহারের ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচানো। বাংলাদেশ প্রথম দিকের দেশ হিসেবে এই কনভেনশনে সম্মতি দান করে। ২০০৫ সালে তামাক পণ্য ব্যবহার নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনে উন্মুক্ত জনপরিসরে ধূমপানকে সীমাবদ্ধ করা হয়, ধূমপানের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয় এবং পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে সিগারেটের প্যাকেটের ওপর ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো উল্লেখ করার কথা বলা হয়। পরে ২০১৩ সালে ওই আইনের সংশোধনী আনা হয়। সংশোধিত আইনটিতে আগের আইনের সবকিছু বহাল রেখে একে মুখ্য তামাক পণ্য ব্যবহার আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি সিগারেটের প্যাকেটের ওপর ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিকগুলোর একটা চিত্রলেখ দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এত বছর পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে শতকরা ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক পণ্য ব্যবহার করছে। মূলত সিগারেট ধূমপানেই তামাকের ব্যবহারে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। কর্মক্ষেত্রে এবং বাসায় যথাক্রমে শতকরা ৪৩ শতাংশ এবং ৩৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরোক্ষভাবে ধূমপান করছে। এ ছাড়া ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের কিশোরদের শতকরা সাত শতাংশই তামাক পণ্য ব্যবহার করে। সেই হিসেবে বাংলাদেশে মোট ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকদ্রব্য ব্যবহার করে। আর এ কারণেই বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক ধূমপায়ী দেশের মধ্যে একটি। উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৮ সালে তাদের এফসিটিসি কনভেনশনের আওতায় তামাকদ্রব্যের ব্যবহারের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ পরিমাপ করতে একটি বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ওই পরিকল্পনার (MPOWER) ছয়টি বিশেষ পদ্ধতিতে বিশ্বব্যাপী তামাকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ পরিমাপ করা সম্ভব বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে। পদ্ধতিগুলো হলো- (১) তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এবং তামাক ব্যবহার রোধে কার্যকরী আইন, (২) তামাক ব্যবহার বিশেষ করে ধূমপান থেকে জনমানুষকে রক্ষা করা, (৩) তামাক ব্যবহার ত্যাগ করতে মানুষকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান, (৪) তামাক ব্যবহারের ভয়াবহ দিকগুলো সম্বন্ধে সতর্ককরণ, (৫) তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণাকে নিষিদ্ধ করা, (৬) তামাকজাত দ্রব্যের ওপর সর্বোচ্চ করারোপ। এই ছয়টি বিশেষ পদ্ধতির মধ্যে ১, ৫, ৬ নম্বর পদ্ধতিগুলোর প্রতিফলন বাংলাদেশের তামাকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনে অনেকটা দেখা গেলেও বাকি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি অবলম্বনের কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যমান ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৫’ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এর আইনটিও সংশোধনের দাবি রাখে। এই আইনটিতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এগুলো দূর করা দরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত ওই বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আজ তামাকমুক্ত সমাজ গড়ার পথে হাঁটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের বিশেষ (MPOWER) রিপোর্ট মোতাবেক চারটি দেশ যথা- ব্রাজিল, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস এবং মরিশাস, উল্লেখিত সবগুলো পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে অবলম্বন করেছে। এতে করে তাদের তামাকদ্রব্য ব্যবহারের মাত্রা অনেক কমেছে। মরিশাসে ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তামাকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ ২২.৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। নেদারল্যান্ডসে ২০১৪ থেকে ২০২১ সালে তামাকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ ২৬ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হয়েছে। এ ছাড়া ব্রাজিল তামাকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ কমানোর ক্ষেত্রে বৈশ্বিক নেতৃত্বে আছে বলা যায়। দেশটিতে এক সময় তামাকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। তবে গত ২০ বছরে ২৩.৮০ শতাংশ থেকে তামাকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৮০ শতাংশে। অন্যদিকে তুরস্কের তামাকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণও গত ১০ বছরে ৪০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। এই চারটি দেশের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ যথা- সুরিনাম, পেরু, তুর্কমেনিস্তান তামাকদ্রব্য ব্যবহার রোধে কার্যকরী নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছে। সুরিনাম তাদের জাতীয় পর্যায়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতায় বেশ কিছু কার্যকরী নীতি বাস্তবায়ন করার মধ্যে ধূমপানমুক্ত পরিবেশ গড়ার প্রচেষ্টায় রয়েছে। তাদের National Tobacco Control Program-এর মাধ্যমে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন রোধ করেছে এবং তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকি করেছে। এর পাশাপাশি সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে প্রায় ৭০ শতাংশ সিগারেটের ক্ষতিকর দিকের কথা ও চিত্রলেখার ছবি দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। বিভিন্ন জায়গাকে তারা ধূমপানমুক্ত পরিবেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে। এসব দেশে তামাকদ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে যে সাফল্য মিলেছে তার পেছনে বাড়তি করারোপ এবং উপযুক্ত আইন প্রণয়নের বিষয়গুলো নিশ্চয় কাজ করেছে। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কনভেনশন ও বিশেষ পদ্ধতির অবলম্বনে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সুফল পাওয়া গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বাংলাদেশ এখনো এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে উঠতে পারেনি।

মরিশাস এবং নেদারল্যান্ডসের ওই সাফল্যের পেছনে এই দুটি বিষয়ে পদ্ধতি অবলম্বনের প্রতি জোর দিতে দেখা গেছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার ত্যাগ করার ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া ফ্রি সেবার মাধ্যমে যে ধূমপানকে প্রতিরোধ করা সম্ভব, যেটা মরিশাসে লক্ষ করা গেছে। সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া গেছে ইরানে। এ ছাড়া তুরস্কে, মরিশাসে এবং অন্যান্য দেশে উন্মুক্ত পার্ক থেকে শুরু করে পাবলিক গার্ডেনগুলোকে অত্যন্ত পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন করে, সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল সেই ২০১০ সাল থেকে। ফলে এই জনপরিসরে ধূমপানের মাত্রা অনেক কমে গেছে। ধূমপায়ীরা নিজে থেকেই এখন ওইসব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় ধূমপান করা থেকে বিরত থাকে। ব্রাজিলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বড় বড় ব্যানার, পোস্টার ব্যবহার করে জায়গায় জায়গায় ধূমপান নিষেধ এবং ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো প্রদর্শন করা হয়। ফলে মানুষ লজ্জা পেয়ে জনপরিসরে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকে। এ ছাড়া এই দেশগুলোর সরকার জাতীয় পর্যায়ে এবং স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক সমাজের সঙ্গে এক হয়ে বিভিন্ন রকমের ধূমপানবিরোধী অভিযান চালিয়ে থাকে। নেদারল্যান্ডসে প্রায় ৭০টি নাগরিক, এনজিও এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন একসঙ্গে মিলে রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে তামাকদ্রব্য ব্যবহারবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে তামাকদ্রব্য ব্যবহার পরিত্যাগ করতে সহায়তা করার জন্য বিশেষ সরকারি কলসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কর্নাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুকে জনপরিসরে ধূমপানমুক্ত শহর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বেঙ্গালুরুতে উন্মুক্তভাবে তামাকদ্রব্য বিক্রয় করা নিষেধ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কনভেনশনে স্বাক্ষর করেও বাংলাদেশে এখনো বেআইনি তামাকদ্রব্য বেচাকেনা বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া ই-সিগারেট ব্যবসা সবার চোখের সামনেই চলছে। ফলে যারা ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রাখতে চাইছে বা রেখেছে তারা আবার এই ই-সিগারেটের প্রতি ঝুঁকছে। বলা হচ্ছে নিকোটিন নেই বলে ই-সিগারেট নিরাপদ। অথচ ই-সিগারেটও অনেক টক্সিক এবং ক্ষতিকারক। ই-ধূমপায়ীদের ই-সিগারেটের এসব নেতিবাচক হয়তো জানানোই হয়নি। যেহেতু তামাকদ্রব্য ব্যবহার একটি সামাজিক ব্যাধি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাকদ্রব্য ব্যবহারকে এক ধরনের মহামারী হিসেবে গণ্য করেছে সে ক্ষেত্রে এই তামাকদ্রব্য ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করতে দরকার সামগ্রিক প্রয়াস। অর্থাৎ সময়োপযোগী আইনের সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি গচঙডঊজ-এর আলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামষ্টিকভাবে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছোট ছোট নীতি ও কৌশল গ্রহণ করে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও বেশি সুসংহত ও কার্যকরী করে তুলতে হবে। সব দিক থেকেই আওয়াজ তোলা চাই- ‘তামাক পণ্যে না’।

ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর