গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যাচ্ছে কেন

মোহাম্মদ মহসীন
২২ জানুয়ারী ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যাচ্ছে কেন

গ্রামীণ খেলা গ্রামেরই অনবদ্য অংশ। এটি লোকসংস্কৃতির ধারক-বাহক বাঙালিদের জনপ্রিয় খেলা। এসব খেলা কার না ভালো লাগে, বিশেষ করে আশির দশকের আগে নব্বই দশক পর্যন্ত গ্রামীণ খেলাগুলো এখনো সবার মনে দাগ কাটে। তখনকার দিনে প্রতিটা ছেলেমেয়ে মিলেমিশে কখনো বিদ্যালয়ে বা বাড়িতে খেলাধুলায় দিন গিয়ে সন্ধ্যা হলে মাঠঘাট ছেড়ে বাড়ি ফিরত। তখন মাঠঘাট, পতিত জমির পরিধি ছিল উন্মুক্ত খোলামেলা শান্ত সুন্দর নির্মল। বর্তমানে উন্মুক্ত খেলার মাঠ অপ্রতুল, ছোট্ট হয়ে যাচ্ছে। যে খেলাগুলোর বেশি প্রচলন ছিল-

গোল্লাছুট : কিশোর-কিশোরীদের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। এ দেশের গ্রামাঞ্চল ছাড়াও শহরাঞ্চলেও এই খেলা ব্যাপক প্রচলিত। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রংপুর, বরিশাল, খুলনায়ও প্রচলন অনেক বেশি। বিদ্যালয়ের মাঠে অথবা খোলা জমিতে শিশুরা খেলে থাকে।

দুটি দলে সমানসংখ্যক ৫ বা ৭ জন খেলোয়াড় খেলতে লাগে। দলপতি মাটিতে পোঁতা কাঠি এক হাতে ধরে অপর হাতে তার দলের অন্য খেলোয়াড়ের হাত ধরে রাখে এবং ২৫-৩০ ফুট দূরে একটি রেখা টেনে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এভাবে তারা পরস্পরের হাত ধরে কেন্দ্র স্পর্শ করে ঘুরতে থাকে। তাদের লক্ষ্য হলো বৃত্তের বাইরে যে কাঠি বা গাছ লক্ষ্যবস্তু তা দৌড়ে স্পর্শ করা।

দাঁড়িয়াবান্ধা : এটি গ্রামীণ খেলার মধ্যে একটি অন্যতম খেলা। আমাদের নিজ এলাকা ছাড়াও সব এলাকার শিশুরাই এ খেলাটি পছন্দের তালিকায় আছে। এটিতে ছেলেমেয়ে এমনকি বড়রাও এ খেলায় অংশ নিতে দেখেছি।

প্রতি দলে ৬ জন করে খেলোয়াড় থাকে। টস করে আক্রমণকারী ও প্রতিরক্ষাকারী স্থির করা হয়। ২৫ মিনিট খেলা, ৫ মিনিট বিশ্রাম আবার ২৫ মিনিট খেলাÑ এই নিয়মে খেলা চলে। খেলার সময় একজন মারা পড়লে অন্য দলের অর্ধাংশ আক্রমণ করার সুযোগ পাবে। এতে একজন রেফারি ৬ বা ১২ জন দাড়িয়া জজ ও ২ জন স্কোরার থাকে...।

ওপেন টু বায়োস্কোপ : গ্রামীণ খেলাধুলার মধ্যে আরেক জনপ্রিয় খেলা। এটি মেয়েদের কাছে ওপেন টু বাইস্কোপ খেলাটি লোকমুখে এখনো বিদ্যমান। এটি একটি সহায়ক খেলা। দল গঠন করার জন্য এই খেলাটি খেলা হয়। ‘এটি একটি ছড়া-গান যা ওপেন টু বাইস্কোপ-নাইন টেন টেলিস্কোপ-চুলটানা বিবিয়ানা-সাহেব বিবির বৈঠকখানা-সাহেব বলেছে যেতেÑ পান-সুপারি খেতে-পানের আগায় মরিচ বাটা-স্ত্রিংয়ের চাবি আঁটাÑ যার নাম মনিমালা...’ এসব কানামাছি, বৌছি, হা-ডু-ডু, পাখি খেলা, ঢাংগুলি, মার্বেল, রশি টানা, ইচিংবিচিং, মল্লযুদ্ধ, লাঠি খেলা, লুকোচুরি, কড়ি, ধাপ্পা, কুতকুত, যেমন খুশি তেমন সাজ, চড়ুইভাতি, এলাডিং বেলাডিং, সাত চাড়া, বিয়ের গান, পুতুলের বিয়েসহ নানা উল্লেখযোগ্য খেলা। নতুন প্রজন্মের কাছে এসব খেলাধুলা একেবারেই গোলকধাঁধা বা কাল্পনিক গল্প ছাড়া আর কিছু নয়।

এই ঐহিত্যবাহী খেলাধুলা বইয়ের পাতায় স্থান নেবে বা নিয়েছে। তবে ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি এবং পহেলা বৈশাখ এলেই লোকসংস্কৃতির গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোর মধ্যে বিস্কুট খেলা, মোরগ লড়াই, হাঁস ধরাÑ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আগে চলমান ছিল।

এক সময় বিয়ে উপলক্ষ্যে উভয় বাড়ির মা-চাচিদের বিয়ের গান গাইতে দেখেছি। সেই গান মেলায় উপভোগ করা যায়। দিনবদলের পালায় গ্রামাঞ্চলে সেই প্রথা নেই।

ঐতিহ্য লালনে শিশু, কিশোর-কিশোরী যখন ঋতুর রঙ্গমঞ্চে আসন পাতে তখন পার্শ¦বর্তী জেলার চরাঞ্চলে নবান্ন উৎসব আয়োজনে থাকে গ্রামীণ খেলা, পালাগান, ওরসও।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় লোকসংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে হলেও গ্রামীণ উৎসবগুলো সব বয়সী মানুষের প্রাণের খোরাক ছিল গ্রামীণ খেলা। বর্তমানে মোবাইল ফোন দেশীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে ভার্চুয়াল জগতের অপসংস্কৃতি। জ্ঞানীজনদের ধারণা নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের ঐহিত্যবাহী লোকসংস্কৃতির পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাই সরকার নতুন কারিকুলামে বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলেও বাস্তবায়ন এখনো চোখে পড়েনি...।

মোহাম্মদ মহসীন : প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, নারায়ণগঞ্জ