সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা প্রসঙ্গে

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী
০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা প্রসঙ্গে

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ কথা হচ্ছে। অনেকেই বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩২, অনেকে ৩৫ করতে চাইছে। বেশ আন্দোলনও হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর পক্ষপাতী নই। আমি মনে করি এটা আসলে আমাদের বর্তমান আমলাতন্ত্রের যে সমস্যা সেই সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় নয়, এমনকি দেশের জন্যও ভালো কিছু নয়। বরং আমরা যদি সরকারি চাকরিতে ল্যাটারাল এন্ট্রির ব্যবস্থা করতে পারি তা হলে বিসিএসের বর্তমান রাজকীয় ভাব বদল হওয়ার সুযোগ বেশি। এতে প্রকৃত মেধার ব্যবহার বেশি হওয়ারও সুযোগ বাড়বে। একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝাই।

এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছর। এর মানে ৩০ বছরের মাঝে আপনাকে সহকারী কমিশনার (প্রশাসন ক্যাডার দিয়ে উদাহরণ দিচ্ছি। কারণ তারা রাজাধিরাজ।) হিসেবে যোগদান করতে হবে। এর পর নিয়ম মোতাবেক সব আইন মেনে প্রমোশন পেয়ে আপনি সচিব পর্যন্ত হতে পারবেন (সকলে না)। এই সহকারী কমিশনার থেকে সচিব হওয়া পর্যন্ত আপনাকে আর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়নি এমন কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে না। আপনি এখনকার নিয়মে সব যোগ্যতা পূরণ করে প্রমোশন পেতে পারবেন।

এখন ধরি, বাংলাদেশের এই বছরে আমার সহকারী কমিশনার লাগবে ১০০ জন। আমি ১০০ জনকেই নেব বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে। ঠিক এখন যেভাবে নেওয়া হয়। এর পরের প্রমোশন হলো সিনিয়র সহকারী কমিশনার/উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা/অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। ধরি আমার ৮০ জন দরকার। এই ৮০ জনই আমি বিসিএস দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া ব্যাচ থেকে নেব এখনকার নিয়মের মতো।

এর পরের প্রমোশন জেলা প্রশাসক। এখানে ল্যাটারাল এন্ট্রি থাকবে। জেলা প্রশাসক এবং সমমর্যাদার মানুষ দরকার ৬০ জন। এর জন্য আর একটা পরীক্ষা হবে যেখানে যে কেউ পরীক্ষা দিতে পারবে যোগ্যতার মানদণ্ড পূরণ করলে। এখানে বয়সের ভার থাকবে ৪০-৪৫, সঙ্গে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ এখানে যারা পরীক্ষা দেবেন তারা চাকরি, ব্যবসা, উদ্যোক্তা ছিলেন। এখন তারা সরকারি চাকরিতে প্রশাসন ক্যাডারে আসতে চান। এই পরীক্ষায় বিসিএস ব্যাচ থেকে নেবে ৫০ জন। ১০ জন নেবে যারা বিসিএস ক্যাডার নন তাদের থেকে। এটাকে বলে ল্যাটারাল এন্ট্রি।

এর পরের পদোন্নতি বিভাগীয় কমিশনার এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনে সহকারী সচিব। এটার জন্য কোনো ল্যাটারাল এন্ট্রি থাকবে না। যারা এর আগের পরীক্ষা দিয়ে জেলা প্রশাসক হয়েছে তাদের মধ্য থেকেই প্রমোশন হবে।

এর পরের উপসচিব> যুগ্ম সচিব> অতিরিক্ত সচিব> সচিব> সিনিয়র সচিব এর জন্য একইভাবে পরীক্ষা হবে এবং ল্যাটারাল এন্ট্রির জন্য ১০-২০% পদ বরাদ্দ থাকবে। বাকিগুলো বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিপ্রাপ্তদের দ্বারা পূরণ করা হবে। প্রত্যেক পদের জন্য আলাদা বয়সসীমা, আলাদা অভিজ্ঞতা চাওয়া হবে। এতে অনেকগুলো সুবিধা হবে।

১। যারা প্রথমে বিসিএস দেয়নি বা হয়নি তারা জীবনে যদি নিজ ক্ষেত্রে পরবর্তীতে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে পারেন, নিজেকে তৈরি করতে পারেনÑ তা হলে সরকারি চাকরিতে আসার আবার সুযোগ পাবে। তাদের বিশেষায়িত জ্ঞান দিয়ে দেশ উপকৃত হবে।

২। বেসরকারি চাকরি করা / ব্যবসা করা মানুষরা সরকারি চাকরিতে এলে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। সমস্যার সমাধান সহজে হবে। এটারও একটা উদাহরণ দিই।

ধরেন একজন মানুষ বেসরকারি ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট জেলায় এনজিওতে চাকরি করেছে মাঠ পর্যায়ে ৫-৭ বছর। তিনি যদি ল্যাটারাল এন্ট্রি পরীক্ষা দিয়ে জেলা প্রশাসক হতে পারেন তা হলে যতটা সহজে সেই জেলার মাঠ পর্যায়ের সমস্যা তিনি বুঝতে পারবেন সেটা অন্যদের জন্য কঠিন। একইভাবে যে ডাক্তার বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেছে সে যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ল্যাটারাল এন্ট্রি দিয়ে প্রবেশ করেন, তা হলে তার জন্য যতটা সহজ হবে হাসপাতালের সমস্যা সমাধান করা সেটা অন্যদের জন্য কখনোই ততটা সহজ হবে না।

৩। বিসিএস দিয়ে চাকরি পাওয়ার পর প্রতিযোগিতা কমে যায় চাকরিপ্রাপ্তদের মাঝে। কারণ তাদের প্রতিযোগিতা থাকে শুধুই নিজেদের মাঝে। এর কারণে তারা তাদের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ব্যবহার কমিয়ে দেয় যা দেশের ক্ষতি। এই ল্যাটারাল এন্ট্রি তাদের সেই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন করবে। যেহেতু তাদের সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে প্রমোশনের জন্য, তারা নিজেদের আরও বেশি সময়োপযোগী করে তৈরি করবেন। তারা চাইবেন সব সময় কাটিং নলেজে আপডেটেড থাকতে। এটি আসলে তাদের কর্মদক্ষতা বাড়াবে যা দেশের জন্যই লাভজনক।

৪। ল্যাটারাল এন্ট্রির ফলে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়ে মানুষের ‘গড লাইক কমপ্লেক্স’ কমবে। কারণ এখন সবাই জানে ৩০ বছরের মাঝে আপনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে না পেরে থাকলে আপনি আর জীবনেও সেটা পারবেন না। এর অর্থ আপনি এর পর জীবনে যাই করেন না কেন সচিব (আবার প্রশাসন ক্যাডারকেই উদাহরণ হিসেবে নিলাম) হবেন না। এটা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি তাদের সমীহ বাড়িয়ে দেয়। এই সমীহ অনেকটা তোষামোদ হয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে যায়, যা তাদের মাঝেও ‘সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ বাড়িয়ে দেয়। দিনশেষে সরকারি কর্মকর্তারাও যেহেতু মানুষ তাই তাদের মাঝে এটা হওয়াটা স্বাভাবিক।

কিন্তু যদি ল্যাটারাল এন্ট্রির ব্যবস্থা থাকে তাহলে এই প্রবণতা অনেকটাই সামাল দেওয়া যায়। কারণ যে কেউ যোগ্যতা থাকলে যে কোনো সময়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারবে। এখানে সরকারি চাকরির ‘অসাধারণত্ব’ এবং ‘দুষ্প্রাপ্যতা’র ব্যাপারটা প্রায় নাই হয়ে গিয়ে এই চাকরিকে গণমানুষের সেবার চাকরির দিকে নিয়ে যাবে।

৫। ল্যাটারাল এন্ট্রির ব্যবস্থা বিসিএসের জন্য জীবন বাজি রেখে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করা বন্ধ করবে লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর। এখন ২৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের মূল্যবান ৫-৬ বছর লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বিসিএস পরীক্ষার জন্য বিনিয়োগ করে যেখানে সফলতার হার ১%। এর অর্থ ৯৯% মানুষের জীবনে এই সময় নষ্ট হয়। যখন ল্যাটারাল এন্ট্রির সুযোগ থাকবে তখন এটি নষ্ট হবে না। কেননা বিভিন্ন পদে সরকারি চাকরিতে যুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতা দরকার হবে যা বাস্তবজীবনে কাজ করেই অর্জন করতে হবে। তাই তরুণ-তরুণীরা শুধু চাকরির জন্য পড়ে সময় নষ্ট না করে, কাজেও মনোনিবেশ করবে।

ল্যাটারাল এন্ট্রির সঠিক সুফল পেতে হলে আমাদের আরও একটা নিয়ম চালু করতে হবে। একজন পরীক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষা সর্বোচ্চ ২ বার দিতে পারবে এবং ল্যাটারাল এন্ট্রির পরীক্ষাও সর্বোচ্চ ২ বার দিতে পারবে। আর বিসিএসের এবং ল্যাটারাল এন্ট্রির পরীক্ষার সময় থেকে নিয়োগ ৮ মাসের মাঝে শেষ করতে হবে। এটা করতে পারলে আমার মনে হয় আমাদের সরকারি চাকরিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে, মেধার সঠিক ব্যবহার হবে এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দলদাস বানানো কমবে। কোনো রাজনৈতিক সরকার এই ব্যবস্থা চালু করবে না বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ এতে তাদের ক্ষতি। রাজনৈতিক সরকারের দুর্নীতি, দখল এবং অপশাসন চালাতে হলে দলদাস সরকারি কর্মকর্তা অপরিহার্য। তাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতেই একটা অসাধারণ সুযোগ আছে, ল্যাটারাল এন্ট্রি ব্যবস্থা চালু করে সরকারি চাকরিতে দলদাস শ্রেণিকরণ বন্ধ করার।

আমি বলছি না আমি যে রূপরেখা দিয়েছি সেটাই করতে হবে। কোন পদ্ধতিতে ল্যাটারাল এন্ট্রি হবে, ফরমেট কী হবে, বেতন-ভাতা কত হবে, কত শতাংশ ল্যাটারল এন্ট্রিতে নেওয়া যৌক্তিক হবে, সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু সরকারি চাকরির বর্তমান ব্যবস্থা বদল করতে হবে। একটা পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেই এমন একটা চাকরি পাওয়া যাবে যার ক্ষমতা এবং দায়িত্ব অনেক কিন্তু আর কেউ কখনো আমার সমকক্ষে এখানে নতুনভাবে যুক্ত হতে পারবে নাÑ এটা আসলে ঠিক যৌক্তিক নয়। দেশের জন্য মঙ্গলজনকও নয়। অন্তত গত ৫৪ বছরে আমরা তাই দেখেছি।

এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই পারে স্থায়ীভাবে সরকারি চাকরিতে দলদাস নীতির পরিবর্তন করতে। কাজটি কঠিন। সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকেই তারা বাধার সম্মুখীন হবেন। যে কোনো শুভ পরিবর্তনে বাধা আসবেই। এই সরকার যদি এই পরিবর্তন করতে পারে তা হলে পরবর্তী ৩০ বছরে বাংলাদেশের যে পরিবর্তন হবে তা অকল্পনীয়। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি এই পরিবর্তনের জন্য ।


রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা