পার্বত্য চুক্তিতে যে কথা বলা হয়নি

মেজর নাসিম হোসেন (অব.)
০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:০৯
শেয়ার :
পার্বত্য চুক্তিতে যে কথা বলা হয়নি

সবাই জানি পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। ‘হাতিয়ে’ শব্দটি ব্যবহার করছি এ জন্য যে তিনি খুবই পুরস্কার লোভী বা খুব প্রচারলোভী ছিলেন। তিনি তার সমকক্ষ কাউকে তার পাশে রাখতেন না। যদি শান্তি চুক্তি একটি ভালো কাজ হয়ে থাকে তবে তো চুক্তির দুই পক্ষই সে ভালো কাজের অংশীদার। সে বিবেচনায় সন্তু লারমাও তো চুক্তি করার জন্য একই ভাবে পুরস্কৃত হওয়ার কথা। এই যেমন প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ইটঝাক রবিন ও ইয়াসীর আরাফাত নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।

আমরা যদি মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি: শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’ শীর্ষক বইটিকে দলিল হিসাবে নেই তাহলে দেখতে পাই বিএনপি সরকারের নেওয়া শান্তি আলোচনা একটা চূড়ান্ত (১৩ তম বৈঠকের পর) পর্যায়ে পৌঁছার পর হঠাৎ করে সন্তু লারমা যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। 

রাশেদ খান মেনন এবং অলি আহাদের সেই খসড়া চুক্তিটি শান্তিবাহিনী আর এগিয়ে নেয়নি। কারণ তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটি যথেষ্ট জোরালো হয়েছে। আওয়ামী লীগ আত্মবিশ্বাসী ছিল সেরকম নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় আসবে। সন্তু লারমাকে এই বার্তা দেওয়া হয় যেন শেষ সময়ে তারা বিএনপি সরকারের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করে। কারণ তা হলে আওয়ামী লীগ সেই চুক্তি বাস্তবায়ন নাও করতে পারে। ভারতের দিক থেকেও চাপ ছিল অপেক্ষা করার জন্য। সন্তু লারমা যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

শেখ হাসিনা চাইছিলেন দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত হানাহানি বন্ধ করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজের একটা ভালো ইমেজ তৈরি করতে। শেখ হাসিনার দিক থেকে এটা ছিল একটা স্মার্ট মুভ। আর কে না জানে পুরস্কার এবং ‘ডক্টরেট ডিগ্রি’ এসবের প্রতি তার ঝোঁকের কথা।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই গঙ্গা পানিচুক্তি করে একটা আলোড়ন তোলেন দেশ-বিদেশে। তার বৈদেশিক নীতির কার্যকরী শক্তি তিনি দেখান।  

সন্তু লারমাও দেখলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুতে ভারত যেহেতু একটা ফ্যাক্টর, অতএব ভারতের ছায়া যদি আওয়ামী সরকারের ওপর থাকে তবে চুক্তি বাস্তবায়নে তা একটা গ্যারান্টর হিসাবে কাজ করবে।

দীর্ঘ এক দশকের যোগাযোগ আলোচনা নানান বাধা-বিপওি পেরিয়ে চূড়ান্ত ফলাফলের সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাকে আর সময়ক্ষেপণ করতে হলো না। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে চুক্তির ঘোষণা এলো। শেখ হাসিনার ‘ম্যাজিক’ দেখল দেশবাসী। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল ভূমি। বসতিকারী বাঙালিদের সরিয়ে নেওয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে বিস্তৃত থাকা সেনাবাহিনীর ছাউনিগুলো সরিয়ে ছয়টি নির্দিষ্ট সেনানিবাসে স্থিতু করা। ‘সেনাবাহিনীর ক্যাম্প নেই’- এই দৃশ্যপট পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীকে একটি বিজয়ের সূচক হিসাবে দেখাতে চেয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটা দখলদার বাহিনী ছিল- ওরা লেজ গুটিয়ে তাদের জন্য সীমিত একটা স্হানে আবদ্ধ করা গেছে- ওরা ওখানে লেফট -রাইট করবে, ভলিবল খেলবে। বাইরে আসবে না, প্রবল শক্তিধর ক্ষমতার আইকনকে আলাদীনের দৈত্যের মতো বোতলে ভরা গেছে!  কি দারুণ এক বিজয়!

কিন্তু শেখের বেটির কূটচাল সন্তু লারমা বুঝতে পারেননি বা পারলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) আর সুবিধা করতে পারেনি তাকে কোনো গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়াই চুক্তি করতে হয়। ভরসা শুধু ভারতের আশ্বাস।

বিপুল পাহাড়ি জনগণের ধারণা বা প্রত্যাশা ছিল চুক্তির পরপরই পাহাড়ের বসতিকারী বাঙালিরা সুড় সুড় করে ট্রাকভরে ভরে লোটা-বাক্সসহ পাহাড় থেকে বের হয়ে যাবে।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর দেখা গেল তেমন কিছু নেই। পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের ব্যানার নিয়ে তখন মাঠে নামল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। বাঙালি প্রত্যাহার সেনাবাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার এসব কোনো কিছুর টাইম লাইন দেওয়া নাই। 

সুচতুর শেখ হাসিনা নাকি কানে কানে আজন্ম বাম ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতা কৌশলী গেরিলা সন্তু লারমাকে কানপড়া দিয়ে চুক্তি করিয়ে নেন। 

 শেখ হাসিনার কৌশল ছিল মৌখিক আশ্বাস। তিনি বলেন, ‘দেখ বাঙালি প্রত্যাহার তো খুব স্পর্শকাতর বিষয়। ওসব লিখলে বিএনপি এটাকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করবে। তার চেয়ে অল্প কয়েক জন বাঙালিই তো ওদের রেশন বন্ধ করে দিলে ওরা না খেতে পেরে এমনিতেই চলে যাবে। আর ওদের জন্য পুনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। তোমাদের পাহাড় তোমাদেরই থাকবে।’

কট্রর বাম সন্তু লারমা শেখ হাসিনার ফাঁদে পা দেন। তিনি মনে করেন, ‘দেখি না কি করে!’ চুক্তির দুই বছরের মাথায় সন্তু তার ‘বেকুবি’ বুঝতে পারেন। 

‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এর নির্বাহী সম্পাদক গোলাম মুর্তজাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সন্তু লারমাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি ক্ষোভে ফেঁটে পরেন। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই বাঙালিদের ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকারের কথা ছিল, সব কিছু কি লিখে করতে হয়, ঈমান থাকতে হয়।’ (সূত্র: শান্তি বাহিনীর গেরিলা জীবন- গোলাম মুর্তজা) 

২৪ বছর ধরে দেশের মানুষ শেখ হাসিনার ঈমানের পরিচয় পেয়েছে। সন্তু লারমার আত্মীয় (ভবদও চাকমা পানছড়ি থানা সভাপতি জেএসএস) এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা সুপন চাকমাকে (নিহত) আমি ২০০৩ সালে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা কি করে ভাবল পাহাড়ের বিপুল সংখ্যক বাঙালিকে কীভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার মতো একটা চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল নেবে। যাদের ৮০% তখন পাহাড়ে জন্ম নেওয়া আর দশজন পাহাড়ির মতো মাটির মধ্যে শিকড় গড়ে উঠেছে। 

আমি অবাক হতাম তাদের জবাব শুনে- কেন নয়? আজ ২৪ বছর পর অনেক পাহাড়িকে বলতে শুনি, ‘তারা আর বিশ্বাস করেন না, বাঙালিদের এখান থেকে আর সরানো সম্ভব।’  

১৯৭৮-৮২ সাল পর্যন্ত যেসব বাঙালি বসতি করার জন্য এসেছিল তাদের অনেকেই বিরূপ পরিস্থিতি, ম্যালেরিয়া, শান্তিবাহিনীর হামলার কারণে পাহাড় থেকে চলে যায়। আজ ৪০/৪২ নিম্ন জনগোষ্ঠীর যা পাহাড়ের বাঙালি সংখ্যার ৮০-৮৫% তারা সব পাহাড়ে জন্ম নেওয়া বাঙালি।

বাংলাদেশের মতো অতি জনবহুল একটি দেশের এই বিপুল জনসংখ্যাকে (৮ লাখ) কোন ভাসান চরে স্থানান্তর করা হবে সেই হোমওয়ার্ক বোধহয় সন্তু লারমা করেননি। তাই মাঝে মাঝেই তিনি তার হতাশার কথা বলে হুমকি দেন, ‘আবার পাহাড় অশান্ত হবে!’ তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলেন। 

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কমানো মোটেই সম্ভব নয়। এটা সন্তু লারমা নিজেও জানেন। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি শুধু কোনো পাহাড়ের চূড়ায় ঘর বানিয়ে থাকা নয়। রাতের বেলায় সেনাবাহিনীর বুটের শব্দ পাহাড় থেকে ‘ভূত-প্রেতের’ উপস্থিতি কমায়- এটা সন্তু লারমা প্রকাশ্যে না হলেও ব্যক্তিগত আলাপকালে স্বীকার করেন।

১৯৫৬ সাল থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী নাগাল্যান্ডে বিদ্রোহ দমনে বিশেষ ক্ষমতাসহ (Armed Forces Special Power Act) নিয়োজিত আছে। আমাদের সেনাবাহিনী তার মূল কাজে মনোনিবেশ করলে তার সক্ষমতা বাড়বে। 

পাহাড় থেকে যারা বাঙালি বিতাড়নের স্বপ্ন দেখেন তাদের উদ্দেশ্যে বৈষম্যবিরোধী সেই গানটা নিবেদন করে লেখাটার ইতি টানছি।

‘দেশটা তোমার বাপের নাকি করছ ছলা-কলা

কিছু বলতে গেলেই ধরছো টিপে গলা…।’

ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চিতে বাঙালি-পাহাড়ি সবাই থাকবে। রক্ত দিয়ে দেশ পেয়েছি, আমরা কেউ আরাকান থেকে সেটেল্ড হইনি। আমরা সবাই বাংলাদেশি।