নারীশক্তিই ছিল গণ-অভ্যুত্থানের মূল প্রেরণা
তোমার মমতা মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা/তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্ব-জননী! তোমার আঁচল পাতা/নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে, বিষ শুধু তোমা দহে/ফণা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণীর ভার বহে/আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে/সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘মিসেস এম. রহমান’। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন কিংবা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূূর্ত। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেখা মিলেছে নারী শিক্ষার্থী, শিক্ষিকা, গৃহিণীদের। ৫ আগস্ট সরকার পতনের অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে নারীরা
নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অনস্বীকার্য
শেহরীন আমিন মনামি, অধ্যাপক, জনপ্রশাসন বিভাগ ও সহকারী প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রত্যেকটা আন্দোলন সফল হওয়ার পেছনে অনেক স্টেকহোল্ডার কাজ করে। তবে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, আন্দোলন সফল হলে তার ক্রেডিট নিতে চায় তুলনামূলক শক্তিশালী গোষ্ঠী। চব্বিশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ছিল ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রয়াস। আর এই ছাত্র-জনতার মাঝে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের শুরুর দিকে যদি তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি স্কুলের নারী শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিটা মিছিল-মিটিংয়ে ছিলেন। কিন্তু খুবই মর্মাহত হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে এত বড় একটা সফল আন্দোলনের পরেও স্বাধীন বাংলাদেশে এখন নারীদের নিরাপত্তা আরও নাজুক। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায় নারীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, মোরাল পুলিশিং এর মতো ঘটনা ঘটছে। এসব তো ফ্যাসিবাদী সরকারের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন বহন করে! অন্যের ক্ষতি না করে কে কীভাবে চলবে সেটা একান্তই তার ব্যাপার। এখানে তো কোনো রকম হস্তক্ষেপ চলতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশে ‘লাইভ অ্যান্ড লেট লাইভ’ নীতিতে বিশ্বাসী হোন। ব্যক্তিস্বাধীনতা যেন খর্ব না করি। কারণ কারও ক্ষতির কারণ না হয়ে নিজের মতো বাঁচার অধিকার সবার আছে। ধর্ম, বর্ণ কিংবা লৈঙ্গিক সমতার জন্য যে বৈষম্যবিরোধী ডাক আমরা একসঙ্গে দিয়েছি সেটা যেন মুছে না যায়। নারীদের অবদানকে স্বীকার করে আমরা যেন নারীদের জন্য নতুন একটা নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে পারি- এই লক্ষ্য নিয়ে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এই আন্দোলন
ডা. মারুফা রহমান, মেডিক্যাল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতন! ভয়ঙ্কর এক সময় গেছে। একের পর এক টেনশনে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত। প্রতিদিন ফেসবুকের গুরুত্বপূর্ণ নিউজ চ্যানেলগুলো চেক করা আর যখন দেখতাম একের পর এক লাশ পড়তেছে সেই সময় প্রচণ্ড হতাশা কাজ করত। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কোনো শুভ সংবাদের জন্য। তবে এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মেয়েরা যে যেখান থেকে পেরেছে আন্দোলনে নেমেছিল ভয়-ভীতি ত্যাগ করে। এই আন্দোলনে ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরাও যে বাঘিনী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে তা তারা দেখিয়ে দিয়েছিল। বেশ কিছু জায়গায় সে সময় মায়েরা রান্না করে এনেছিল, বাচ্চারা না খেয়ে আন্দোলন করছে তাই তাদের খাওয়ানোর জন্য। পুলিশি বাধা অতিক্রম করে মায়েরা সবার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে এই দৃশ্যের কথা বইয়ে পড়েছিলাম যুদ্ধের বর্ণনা পড়ার সময়, আর ২৪ সালে তা নিজের চোখে দেখেছি। যে মেয়েরা বাইরে বের হতে পারেনি তারাও বাসা থেকে অনেক বড় অবদান রেখেছিল বিশেষ করে ইন্টারনেট ডাটা অফ করার সময়। ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড সবার জন্য ওপেন করা, জানালা দিয়ে পানি, শুকনা খাবার সরবরাহ, আবার সেই সময় কোনো কোনো সাহসী মা ছেলেদের নিজ উদ্যোগে আন্দোলনে নিয়ে এসেছিলেন, যা অসীম সাহসী না হলে আসলেই সম্ভব না। অনেক মা তাদের ছেলেদের পুলিশের ভ্যানে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বুক চাপড়ে সাহস জুগিয়েছে। তাদের এই ত্যাগের অবদান এই আন্দোলনের স্মৃতি পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আন্দোলনের বড় শক্তি ছিল নারীরা
নাহিদ ইসলাম, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা
আরও পড়ুন:
বৈষম্য ঘোচানোই সত্যিকার মানবিক অর্জন
চব্বিশের আন্দোলনের একটি বড় শক্তি ছিল নারীরা। বিভিন্ন ধর্ম, মতের কিংবা ভিন্ন পোশাকে নারী শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী ও উদ্যোক্তারা যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তারা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নারীশক্তিই এ অভ্যুত্থানের মূল প্রেরণা। সে প্রেরণায় আমাদের নতুন করে রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করতে হবে। তাহলেই আমরা নতুন এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল চব্বিশের বিপ্লবে
ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম, অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিই নারী। আর এ নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমি দেখতে পেয়েছি চব্বিশের বিপ্লবে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে। নারী শিক্ষার্থী, নারী- কিশোরী-যুবা, এমন কী নারী শিক্ষক ও অন্য সহকর্মীদের জোরালো অংশগ্রহণ ছিল। যা আমাদের সবাইকে করেছে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন পরিসরে তাদের নেতৃত্ব, সমর্থন ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আমি দেখেছি বৈষম্যবিরোধী, নিপীড়ন বিরোধী, সন্তানের পাশে অভিভাবকসহ নানা সমাবেশ ও কর্মসূচি হয়ে উঠেছিল সফল। ফলে চব্বিশের বিপ্লবে তাদের রয়েছে বিশেষ অবদান। এ মুহূর্তে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে দেশে বিদ্যমান সব বৈষম্য দূরীভূত হোক, সব মানুষের অধিকার ও পছন্দ নিশ্চিত হোক।
ছাত্ররা যদি সাহসী হয়, তাহলে ছাত্রীরা শক্তি
জান্নাতুন নাঈম, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কাজী নজরুল তো আর এমনি এমনি বলেননি- বিশ্বে যাহা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। চব্বিশের বিপ্লব এতটা সহজ হতো না যদি নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ না থাকত। কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০১৮-তেও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। চব্বিশে এসে সেটা দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ নয় বহুগুণে। আমাদের যখন রাজাকার বলা হয় তখন মেয়েরা হল থেকে মধ্যরাতে বেরিয়ে প্রতিবাদে বেরিয়ে পড়ে। আমাদের মেয়েরা একতার পরিচয় দিয়েছিল। এতে করে আমাদের ভাইয়েরা সাহস পেয়েছে। ছাত্ররা যদি সাহসী হয়। তাহলে ছাত্রীরা শক্তি। সাহস ছাড়া যেমন শক্তি কাজে আসে না। তেমনি শক্তি ছাড়াও সাহস কাজে আসবে না। তাই দুটো মিলে এক মহা সাহসী শক্তির জন্ম নিয়েছিল পুরো আন্দোলন। আন্দোলনের প্রথম সারি থেকে দেখেছি আমাদের মেয়েদের অবদান ও অর্জন। ১৫ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলায় বাদ যায়নি মেয়েরাও। হামলার পর মেয়েরা ভয় না পেয়ে শহীদ মিনারে এসে দাঁড়াই। এতে করে আমার ভাইরা সাহস পেয়েছিল। ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেয়েরা জড়ো হয়েছিল শাহবাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রোদের মধ্যে, মধ্য দুপুর থেকে বোরকা হিজাব পরে, ভিজে ঘামে একাকার হয়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছিল পুরোটা শাহবাগ চত্বর। চব্বিশের স্বাধীনতার পরও আমাদের মেয়েরা থেমে যায়নি। আহতদের দেখাশোনা, খোঁজ-খবরসহ প্রতিটি কাজে নারীর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন:
ইবিতে শীতের আগমনী বার্তা
চব্বিশের বিপ্লবে নারী
ড. শহীদুল জাহীদ, অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বৈরাচার হটাও আন্দোলনের স্মৃতি লিখতে গেলে অনেক কথাই মনে পড়ছে। ৩ তারিখে শহীদ মিনার অভিমুখে মিছিল-সমাবেশ ছিল সম্মিলিত ছাত্র-জনতার। ছাত্র জনতার বাঁধভাঙা বিপ্লবী সমাবেশে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তা ভুলেই গেছি। ওদিকে আবার কারফিউ। সাত পাঁচ ভেবে বাসার দিকে রওনা হলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, পুলিশ, বিজিবি, আর্মির সরব উপস্থিতি। লক্ষ্য করলাম ৮-১০ জন মেয়ে কিছু বলতে বলতে হেঁটে আসছে। যথারীতি তাদের মাথায় লাল সবুজের জাতীয় পতাকা বাঁধা আর হাতে ছোট লাঠি যা আন্দোলনের ল্যান্ডমার্ক হয়ে গিয়েছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাদের পরিচয়। ওরা বলল কেউ ইডেন কলেজ আবার কেউ সুদূর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে এতদূর থেকে কারফিউয়ের মধ্যে কীভাবে এলো। এরা বলেছিল যে কষ্ট হলেও সাহস করে এসেছে। কিন্তু যে কথাটি আমার মনে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তা হলো, আমার পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা সমস্বরে বলে উঠল, স্যার আপনাদের ভয় নাই। হ্যাঁ, অল্প বয়সী একদল ছাত্রী, আমাদের ছোট বোন যেভাবে সমস্বরে আমাদের শিক্ষকদের অভয় দিয়েছিল তা কোনোদিন ভোলার নয়।