কে হচ্ছেন শ্রীলংকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট
শ্রীলংকার জনগণ ভোটের মাধ্যমে আগামীকাল ২১ সেপ্টেম্বর তাদের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। নির্বাচনের এই দৌড়ে এবার অংশ নিচ্ছেন ৩৮ জন। সংখ্যার দিক থেকে নেহাত কম নয়। এই দৌড়ে যাদের নাম আগে আসে তাদের মধ্যে রয়েছেন নামাল রাজাপাকসা, সাজিথ প্রেমাদাসা, রানিল উইক্রেমেসিঙ্গে প্রমুখ। শ্রীলংকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই নামগুলো সুপরিচিত। নামাল রাজাপাকসা হচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসার বড় ছেলে; সাজিথ প্রেমাদাসা হচ্ছেন আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসার ছেলে; রানিল উইক্রেমেসিঙ্গে হচ্ছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং দেশটির প্রথম নির্বাহী প্রেসিডেন্ট জেআর জায়েওয়ার্দেনের বোনের ছেলে।
তারা যে প্রেক্ষাপটে এবারের নির্বাচনে অবতীর্ণ হচ্ছেন, সেই প্রেক্ষাপটটি রচিত হয়েছিল ২০২২ সালে। সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন গোটাবায়া রাজাপাকসা। তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসা তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী; গোটাবায়ার আগে মাহিন্দাই ছিলেন প্রেসিডেন্ট। তাদের রাজনৈতিক দলটির নাম শ্রীলংকা পডুজানা পেরামুনা। একবার বড় ভাই প্রেসিডেন্ট তো আরেকবার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট (বড় ভাই তখন আবার প্রধানমন্ত্রী)! শ্রীলংকাকে তারা রাজাপাকসাদের জমিদারী করে নিয়েছিলেন, তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। ফল যা হয়েছিল তা অবশ্য শ্রীলংকার জন্য ইতিহাসÑ অর্থনীতিতে ধস নেমেছিল, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্যের অভাব দেখা দিয়েছিল আর মূল্যস্ফীতি আকাশে উঠে গিয়েছিল রকেটের গতিতে (রাজাপাকসাদের রত্নভাণ্ডার অবশ্য ভারী হয়েছিল নানারকম মণিমাণিক্যে)। এর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল একটি আন্দোলনÑ ‘আরাগালায়া’। সিংহলী ভাষায় আরাগালায়া শব্দের অর্থ সংগ্রাম। সংগ্রামেই নেমেছিল দেশটির সর্বসাধারণ নাগরিকরা। সরকারের দুর্নীতি আর লুটপাটের বিরুদ্ধে সেই সংগ্রামে জনতার জয় হয়; ২০২২ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া পদত্যাগ করলে রাজাপাকসাদের একচেটিয়া জমিদারীর অবসান ঘটে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে চলেছে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নামাল রাজাপাকসার ব্যাপারে ভোটারদের মনে তিক্ত অতীত ছায়া ফেলতে পারে; সাজিথ প্রেমাদাসা কিংবা রানিল উইক্রেমেসিঙ্গে হয়তো ভোটারদের মনে নাড়া দিতে পারেন। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে শ্রীলংকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি নামÑ আনুরা কুমারা দিশানায়াকে।
শ্রীলংকার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি জানাথা ভিমুক্থি পেরামুনা (জেভিপি)- অর্থাৎ পিপল’স লিবারেশন ফ্রন্ট গঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে একবার এবং ১৯৮৭-৮৯ সালে আরেকবার শ্রীলংকা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে অবতীর্ণ হয়েছিল দলটি। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর ১৯৯৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয় জেভিপি, পরে নিজেকে প্রত্যাহার করে জাতীয়তাবাদী শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টিকে সমর্থন দেয়। ওই সময় শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি ছিল প্রধান বিরোধী দল। ২০০৪ সালে ইউনাইটেড পিপল’স ফ্রিডম অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে সরকারে যোগ দেয় জেভিপি এবং লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) বিরুদ্ধে যুদ্ধে সরকারকে সমর্থন করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জোট সরকার থেকে বেরিয়ে আসে। পরে নিজেই জোট গঠন করে নাম দেয় ন্যাশনাল পিপল’স পাওয়ার (এনপিপি)। বর্তমানে শ্রীলংকার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অবস্থান করছে এই জোট।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
জেভিপিরই এখনকার নেতা আনুরা দিশানায়াকে। আগামীকাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে যাদের দেখা যাচ্ছে সামনের সারিতে, বলা হচ্ছে দিশানায়াকে তাদের অগ্রবর্তী। স্থানীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের ধারণা, শ্রীলংকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার সম্ভাবনা প্রবল। নির্বাচনী দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন তিনি। পর্যবেক্ষকদের ধারণা সত্যি হলে বলতে হবে, শ্রীলংকাবাসী প্রথমবারের মতো একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেতে চলেছে।
এরই মধ্যে একটা বিষয় থেকে উদ্ভব ঘটেছে নানান চিন্তার। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে আচানক ভারত সরকার আনুরা দিশানায়াকেকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানায়। তিনি সেখানে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ হয়। ৫৫ বছর বয়সী আনুরা দিশানায়াকে সরকারে নেই, তার রাজনৈতিক জোটও প্রধান বিরোধী পক্ষ নয়। শ্রীলংকার ২২৫ সদস্যের পার্লামেন্টে দিশানায়াকের নেতৃত্বাধীন এনপিপির আসন মাত্র তিনটি। অন্যদিকে জেভিপিকে চীন-ঘনিষ্ঠ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। সবারই জানা, ভূরাজনীতিতে ভারতের কাছে চীন হচ্ছে প্রধান প্রতিপক্ষ। এমন অবস্থায় দিশানায়াকেকে ভারতের আমন্ত্রণ ও তার সঙ্গে ভারতীয় কর্তাব্যক্তিদের সাক্ষাৎ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
২০২২ সালে শ্রীলংকার অর্থনীতিতে ধস, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যদ্রব্যের অভাব ও রকেট-গতির মূল্যস্ফীতি ছিল জেভিপি ও এনপিপির টার্নিং পয়েন্ট। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে আরাগালায়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ব্যাপক গণআন্দোলনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা পদত্যাগ করেন, মাহিন্দা রাজাপাকসাকেও প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় এবং জনরোষ থেকে দুই ভাই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। যদিও কোনো রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দাবি করেনি, তবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল জেভিপি। রাজাপাকসা ভাইয়েরা পালিয়ে যাওয়ায় যে পাওয়ার ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়, সেটাই বৃহত্তর পরিবর্তনের ডাক দেওয়ার পথ করে দিয়েছিল আনুরা দিশানায়াকে ও জেভিপিকে। এভাবেই প্রান্তসীমা থেকে উঠে এসে গ্রহণযোগ্য প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠে দলটি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে দিশানায়াকে কি পারবেন দুর্র্নীতি দূর করে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে বৃহত্তর পরিবর্তন আনতে? গামিনি ভিয়ানগোডা শ্রীলংকান লেখক ও রাজনীতি বিশ্লেষক। এ ছাড়া শ্রীলংকায় গণতান্ত্রিক সংস্কারে সাগরিক সমাজের পুরাওয়েসি বালায়া আন্দোলনের সহ-আহ্বায়ক। সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে তিনি বলেছেন, ‘তিনি (দিশানায়াকে) সিস্টেম পরিবর্তনের উদ্যোগে সৎ। তিনি যখন বলেন দুর্নীতির দরজা বন্ধ করে দেবেন, আমি বিশ^াস করি তিনি সত্যিই তা করবেন। কাজটা তিনি করতে পারবেন কী পারবেন না সেটা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু এই খাঁটিত্ব আর কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে আমি দেখি না।’
গামিনি ভিয়ানগোডা আর কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে যা দেখতে পাচ্ছেন না, তা দেখতে না-পাওয়া নিশ্চয় দুর্ভাগ্যের। যে খাঁটিত্ব দেখা যাচ্ছে আনুরা দিশানায়াকের মধ্যে, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ওই খাঁটিত্ব না থাকলে, তাদের কথা ও কাজ দুই রকম হলে জাতির কী ধরনের অমঙ্গল হয়, রাজাপাকসা ভাইদের আমল তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিকতার পথে শ্রীলংকাবাসী তাদের আকাক্সিক্ষত পরিবর্তনের দেখা পাবে কিনা, সময়ই তা বলে দেবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
প্রমিত হোসেন : সাহিত্যিক ও অনুবাদক; দৈনিক আমাদের সময়ের সহযোগী সম্পাদক