সবার প্রত্যাশা এখন রাজনীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গন

জাহিদ রহমান
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
সবার প্রত্যাশা এখন রাজনীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গন

বিগত দিনে সব রাজনৈতিক সরকারের আমলেই দেশের ক্রীড়াঙ্গন অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণ হয়েছে বললে ভুল হবে না। ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতি ও দলীয়করণের নামে চলেছে একশ্রেণির কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহার, অযোগ্যদের বাড়াবাড়ি, যোগ্যদের দূরে রাখা, দলবল নিয়ে বিদেশ সফরের হিড়িক, ফেডারেশন থেকে ক্রীড়া সংস্থায় আত্মীয়করণ, যোগ্যদের জাতীয় পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করাÑ এ রকম আরও অনেক কিছু। এসব কুৎসিত কদাকার চিত্র দেখা গেছে জাতীয় পর্যায় থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত। আবার বিভিন্ন সময়ে অনেককেই দেখা গেছে, যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা না থাকলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ফেডারেশনের মূল চেয়ার দখলে রাখতে। কেউ কেউ নানান অজুহাত এবং কূটকৌশলে ফেডারেশনের সভাপতি পদ ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর। কিন্তু পদের বিপরীতে সঠিক প্রতিদান দিতে বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়েছেন। এসব কারণেই ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিক্স, শুটিং, সাঁতার, আর্চারি, দাবা যাই বলি না কেনÑ সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ঘুরপাক খেয়েছে কিছুটা এই ভালো, এই মন্দের ঘূর্ণিপাকে। কোনো ইভেন্টের হাত ধরেই ধারাবাহিকভাবে গৌরবময় ফলাফল বয়ে আসেনি। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বলতা যতটা ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল তা হয়নি।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই সর্বত্র দাবি ওঠে অন্যান্য খাতের মতো ক্রীড়াঙ্গনকেও মেরামত বা সংস্কারের। ক্রীড়াপাড়ায় তাই অনেকেই মিছিল-মিটিং করেছেন পদ আঁকড়ে ধরে রাখা এবং দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে। দলীয়করণের পুরনো আবর্ত থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত করার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে সর্বত্র। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তাই শুরুতেই বলেছেন পরিবর্তনের কথা। সেই পরিবর্তনের ধারায় ইতোমধ্যেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সব কমিটি। বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে যোগ্যদের নিয়ে এডহক কমিটি গঠন করতে। এদিকে ৪২টি ফেডারেশনের সভাপতিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনে বিদ্যমান ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন, বোর্ড ও সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব দিতে সার্চ কমিটিও গঠন করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে। পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে সাবেক জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন জোবায়েদুর রহমান রানাকে। সদস্য হিসেবে আছেন সাবেক হকি খেলোয়াড় মেজর (অব.) ইমরোজ আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, ক্রীড়া সংগঠক মহিউদ্দিন আহমেদ বুলবুল এবং ক্রীড়া সাংবাদিক মন্টু কায়ছার। ক্রীড়াঙ্গনে এই পরিবর্তন ও উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বার্তা।

এ কথা সত্য, বিগত দিনে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বেশির ভাগ ফেডারেশনেই পরীক্ষিতদের জায়গা হয়নি জটিল ক্রীড়া রাজনীতির কারণে। বিভিন্ন ফেডারেশনের নির্বাচন নিয়ে বহু আগে থেকেই রাজনীতিকরণ, দলীয়করণের অন্তহীন অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচন এলেই আত্মীয়স্বজনের কাউন্সিলর বানিয়ে নির্বাচনে জেতার দৃশ্য দেখা গেছে সব সময়। ক্রীড়াঙ্গনকে এই ধরনের অবস্থা থেকে মুক্ত দেখতে চান অনেকেই। সে কথাই বলছিলেন সাবেক তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু। তার মতে, ক্রীড়াঙ্গনে অভিজ্ঞ, মেধাবীদের নেতৃত্ব থাকতে হবে। যারা হবে ক্রীড়ার উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ। একই সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গন থেকে তদবিরবাজ, লেজুড়বৃত্তিকারী অমেধাবীদের চিরতরে তাড়াতে হবে। কাউন্সিলর বানানোর বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। একই ধরনের কথা শোনা গেল সাবেক তারকা অ্যাথলেট, কোচ এবং অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আলমের মুখেও। এই শাহ আলমের হাত ধরেই প্রয়াত অ্যাথলেট শাহ আলম, বিমল চন্দ্র তরফদার, প্রয়াত মাহবুবুল আলমরা আশি ও নব্বই দশকে অনুষ্ঠিত সাফ গেমস থেকে স্প্রিন্টারের লড়াই থেকে স্বর্ণ জয় করে এনেছিলেন। কিন্তু দুভার্গা বাংলাদেশে তাদের পরে আর কেউ স্প্রিন্টার থেকে স্বর্ণ জয় করে আনতে পারেননি। শাহ আলমের মতে, অতিমাত্রায় দলীয়করণের কারণেই দেশের অ্যাথলেটিক্সে আর নতুন সূর্য ওঠেনি। অথচ দেশের শত সম্ভাবনাময় ইভেন্ট ছিল এটি। অ্যাথলেটিক্সে নতুন করে ভালো ফলাফল তৈরির ভিত তৈরি করতে হলে অভিজ্ঞ সাবেক অ্যাথলেট ও প্রশিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিকল্প নেই।

সাবেক তারকা খেলোয়াড়দের অনেকেই বলেছেন, গত ১৫ বছর ক্রীড়াঙ্গনে কিছু সফলতা থাকলেও অনাচারের তালিকাও দীর্ঘ। ক্রীড়াঙ্গনে দলীয় লোক আর অযোগ্যদের চোটপাটের কারণে মেধাবী প্রজ্ঞাবান সাবেক খেলোয়াড়, সংগঠকদের দূরে সরে থাকতে হয়েছে। জেলাগুলোতেও এই দৃশ্য ছিল দিনের পর দিন। যশোর জেলার কথাই ধরা যাক। যশোরের ‘ফুটবলার সাথী’-ফুটবলমোদীদের হৃদয়ে নামটি এখনো এভাবেই অক্ষত হয়ে আছে। ফরোয়ার্ড লাইনের সেই দুরন্ত-দুর্বার ফুটবলার সাথী ফুটবল নিবেদিতপ্রাণ হলেও কোনোদিন জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে কাজ করার সুযোগ পাননি। বিগত দিনে নিজে জেলাতে রাজনৈতিক পরিচয়ের অখেলোয়াড় লোকজনের দাপটে কোনোদিন নিজের মাঠের অভিজ্ঞতা যশোর জেলার জন্য কাজে লাগাতে পারেননি। আক্ষেপ তার বুকভরা। তার মতে, খেলাধুলার ঐতিহ্যময় জেলা যশোর খেলাধুলা থেকে হারিয়ে গেছে শুধু ক্রীড়া সংস্থা অখেলোয়াড়দের পুনর্বাসন প্রকল্প হওয়ার কারণে। বাংলাদেশের ফুটবলের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্যদের মতো সাবেক এই ফুটবলারও ভীষণ হতাশ। তিনি মনে করেন বাংলাদেশের ফুটবলকে আগের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে ক্রীড়াঙ্গনকে শতভাগ দলীয়মুক্ত রাখতে হবে। জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো ঢেলে সাজাতে হবে।

বিগত দিনে জাতীয় পুরস্কার প্রদান নিয়েও আমরা দেখেছি নানান ছলচাতুরী। ১৯৭৬ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। ক্রীড়াক্ষেত্রে যারা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখেছেন তারা এই পুরস্কারটি পাওয়ার বড় দাবিদার। কিন্তু এই পুরস্কার প্রদান কখনোই সঠিকভাবে করা হয়নি। ফলে অনেক যোগ্য সাবেক তারকা খেলোয়াড়, কোচ, সংগঠক, রেফারি এই পুরস্কার পাওয়া থেকে যুগের পর যুগ ধরে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার বিপরীতে এমন সব ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তারা কোনাভাবেই এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য অন্যদের তুলনায় অগ্রগণ্য নন। দেশের সাবেক প্রখ্যাত ফুটবলার গাজীপুরের আজমত এই পুরস্কার না পাওয়ার বেদনা নিয়েই প্রয়াত হয়েছেন। সাবেক তারকা ফুটবলারদের মধ্যে কোহিনুর, আবুল, আজমত, জোসী, কানন, এমিলি, সাব্বির এখনো কেন জাতীয় পুরস্কার পাওয়া থেকে বঞ্চিত এই উত্তর কারও জানা নেই। পুরস্কার না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই আজমত চলে গেছেন পরপারে। অথচ আশির দশকে আজমত ছাড়া জাতীয় ফুটবল দল কল্পনার বাইরে ছিল। ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি প্রয়াত হন। রক্ষণভাগ সামলে বাংলাদেশের যেসব ডিফেন্ডার ফুটবল ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম আজমত। এই নামটা এখনো শুনলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক জাদুকর ডিফেন্ডারের প্রতিচ্ছবি। যাকে ভেদ করে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ডি-বক্সে ঢুকে গোল করা ছিল ঘুপচির টং দোকানে আড্ডামারা ফুটবলপ্রেমীদের কাছে আজমত পরিচিত ছিলেন ‘বেড়া’ হিসেবে। ’৮৬-তেও তার অধিনায়কত্বে পাকিস্তান কায়দে আজম ট্রফিতে খেলে বাংলাদেশ।

আরও একটি উদাহরণ দিই। দেশের রূপময় ফুটবল ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য নাম কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু। তবে ফুটবলার হিসেবে নয়, তিনি অনন্য হয়ে আছেন একজন তারকাখচিত রেফারি হিসেবে। আশির দশকে ফুটবলের যখন বাঁধভাঙা জনপ্রিয়তা সেই সময়ে বেশির ভাগ ‘বিগম্যাচ’ই পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ত তার ওপর। বিশেষ করে দেশজুড়ে উত্তাপ ছড়ানো মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেকটা অনিবার্য ছিলেন রেফারি কাজী আনসারুল ইসলাম মিন্টু। সে সময় আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যকার ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করাটা ছিল রেফারিদের কাছে সবচেয়ে দুরূহ-দুঃসহ কাজ। আনসারুল ইসলাম মিন্টু সেই রেফারি যিনি মোহামেডান ও আবাহনীর মধ্যে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে বেশি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। রেফারি জগতের এই কিংবদন্তি আজ পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কারের স্বীকৃতি পাননি। সাবেক তারকা ফুটবলার কানন বলছিলেন বিগত দিনে ক্রীড়াঙ্গনে যা যা হয়েছে সেখান থেকেই আমাদের শিক্ষা নিয়ে এগোতে হবে। রাজনীতিকরণ, দলীয়করণের বৃত্তের বাইরে আনতে হবে ক্রীড়াঙ্গনকে। ক্রীড়া নিবেদিতপ্রাণগুলোকে ক্রীড়ার উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। অন্ধ হয়ে কাজ করলে ক্রীড়াক্ষেত্রে কোনো সুফল আসবে না।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক ও সাংবাদিক