শিক্ষার্থীরা কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চায়
৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশের যাত্রা চলছে। সবদিকে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও দেখছেন নতুন আশার আলো। কেমন বিশ^বিদ্যালয় চান শিক্ষার্থীরা সেই সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন -নোমান বিন হারুন
প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক অনিয়ম দূর করতে হবে
মিনহাজুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে যদি কেবল ইট-পাথর নির্মিত আঙিনা বোঝানো হয়, তা যথার্থ নয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি এমন এক ক্যাম্পাস চাই যেখানে প্রতিটি ইটের মধ্যে থাকবে স্বপ্ন, জ্ঞান, ন্যায় ও আলোর চিহ্ন। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো অপরাজনীতি থাকবে না। রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে শুরু করে হল অফিস, ক্লাসরুম কোথাও শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের অনিয়ম বা অবহেলার শিকার হবে না। সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল লোকেদের হাতেই বিশ^বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যাবলি পরিচালিত হবে। পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের মসজিদ, মন্দির, গির্জাগুলো ধর্মীয় কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে ধর্মমতের চর্চা থাকবে, সবাই সবার সুস্থ সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করবে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নতুন বাংলাদেশে যে সূর্য উদিত হয়েছে তার আলোর ছোঁয়া বিশ^বিদ্যালয়ের আঙিনাতেও এসে পৌঁছাক।
ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই
কানিজ ফাতেমা স্মরণী, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাম্পাসের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আবেগ জড়িত। বিশ^বিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ একজন শিক্ষার্থীর মনোজগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে; ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক উন্নতিতে ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বড় বাধা ছাত্ররাজনীতি। আমরা একটা সুন্দর রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে শিক্ষা কার্যক্রমে অযাচিত বিঘ্ন ঘটবে না। শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের পথে হাঁটতে পারবে। বিশ^বিদ্যালয়ে সেশনজট নির্মূলে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে বৈধ সিট নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণে প্রশাসনকে সচেষ্ট থাকতে হবে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের পূর্বের উপাচার্যদের মতো ‘প্যারিস রোডে গাছ লাগানোই সার্থকতা’ এমন মানসিকতা রাখা যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব ভিন্নমতের মানুষ তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে। সর্বোপরি বিশ^বিদ্যালয়ে একটি শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ চাই।
শিক্ষার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করতে হবে
সামিয়া আক্তার
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
বৈষম্য ঘোচানোই সত্যিকার মানবিক অর্জন
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ স্বায়ত্তশাসিত বিশ^বিদ্যালয়। বিশ^বিদ্যালয়কে নতুন করে সাজাতে চাইলে সব ধরনের প্রকার লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করতে হবে। বগিভিত্তিক রাজনীতির নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করা চলবে না। ছাত্র সংসদ ও চাকসু চালু করতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা নিরসন করতে হবে। শহর থেকে দূরবর্তী ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা চরম আবাসন সমস্যার সম্মুখীন হয়। হলের নানা সুযোগ-সুবিধা ও খাবারের মানের দেখভাল করার কেউ নেই। আয়তনে বৃহৎ হলেও বিশ^বিদ্যালয়ে যথাযথ অবকাঠামোগত উন্নয়ন নেই। শ্রেণিকক্ষগুলোতে পর্যাপ্ত আসনব্যবস্থা, উন্নত ও আধুনিক মানের শিক্ষা উপকরণ নেই। লাইব্রেরি ও সেমিনারগুলোর সংস্কার এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতে শিক্ষকদের মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি
আল কোরেশ মুনা, শিক্ষার্থী
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
বিভিন্ন সূচকে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের চেয়ে এগিয়ে আছে। তবে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা ও ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রের কথা বিবেচনা করে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়েও নানাবিধ সমস্যা আছে। এখানে গ্রেডিং সিস্টেমে পৃথক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ে যেখানে ৮০ শতাংশ নম্বর পেলে এ প্লাস বলে গণ্য করা হয়, সেখানে আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ে ৯০ শতাংশের উপর নম্বর পেতে হয়। এ ছাড়া প্রতি সেমিস্টারে যেখানে ফলাফলের উপর ভিত্তি করে শিক্ষাবৃত্তি দেয়ার কথা, সেটাও সবার জন্য নিশ্চিত করা হয় না। এছাড়া যথাসময়ে সেমিস্টার শেষ না করায় অঘোষিত সেশনজটে পড়তে হয় আমাদের। তাই বিশ^বিদ্যালয়কে নতুন করে সাজাতে চাইলে সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
আরও পড়ুন:
ইবিতে শীতের আগমনী বার্তা
নবীন শিক্ষার্থীদের আতঙ্কের নাম সেশনজট
তাসমিয়া সরকার, শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সেশনজট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ বিষয়ে রূপ নিয়েছে। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এদিকে খুব বেশি খেয়াল নেই। ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা কিছু মাস আগে ভর্তি পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেও ক্লাস শুরুর ক্ষেত্রে এখনো বেশ বিলম্ব হচ্ছে। নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস যথাসময়ে শুরু না হওয়ায় সেশনজটের আশঙ্কা বাড়ছে, যা আমাদের একাডেমিক বছরকে দীর্ঘায়িত এবং চাকরির বাজারে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার দিকে আগ্রহী হচ্ছেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, সেশনজটের মতো একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানে শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। আশা করি, নতুন প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে আমরা নবীন শিক্ষার্থীরা একটি নির্বিঘ্ন ও ফলপ্রসূ শিক্ষাজীবন উপভোগ করতে পারি।
ক্যাম্পাস থেকে গণরুম বিলুপ্ত করতে হবে
আলী হাসান মর্তূজা, শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
আগামীর পৃথিবী হবে নিপীড়িত মানুষের
নতুন বাংলাদেশের ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে গণরুম মুক্ত আবাসন ব্যবস্থা সময়ের দাবি। একজন শিক্ষার্থী প্রথমবর্ষে যখন বিশ^বিদ্যালয়ে আসে, তখন সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে তাকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, চারপাশের মানুষের অমানবিক আচরণের মধ্য দিয়ে তাকে শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে হয়। তার উপর গেস্টরুমে ম্যানার শেখানোর নামে চলে অসভ্য আচরণ। গণরুমে নির্ঘুম রাত পার করার পর দিনের বেলা ক্লাসে মনোযোগ দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। যথাযথ পড়ার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তার কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়। অকৃতকার্য হয়ে অনেকেই পরবর্তী ব্যাচের সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়। গণরুমে অবস্থান করার কারণে অনেকেই শারীরিক ও মানসিক নানা রোগে আক্রান্ত হয়। শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়তে হলে ক্যাম্পাস থেকে গণরুম বিলুপ্ত করতে হবে। শিক্ষকদের মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।