এবার পুনর্বাসনে মনোযোগ দিতে হবে
বন্যা হচ্ছে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রতিবছরই তা কমবেশি অবধারিত। আর এ বছর বন্যার চিত্র ভয়াবহ প্রলয়ঙ্করী আকার ধারণ করেছে। গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবের কারণে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে খারাপের দিকে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দুর্গত জেলাগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা দিয়েছে বিপর্যস্ত অবস্থা। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এবারের বন্যা নদীতীরবর্তী মানুষের সক্ষমতাকে আঘাত করেছে। বাড়ি-ঘর বিনষ্ট হয়েছে। লাখ লাখ বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজ তলিয়ে গেছে, হাজার হাজার জমির ফসল নষ্ট হয়েছে; বীজতলা, মাছের ঘের, সবজিক্ষেত, মানুষের বসতবাড়িÑ সবই ধুয়ে গেছে। লক্ষ-কোটি টাকার সম্পদ বিলীন হয়ে গেছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিলÑ ছাত্র-জনতা সবাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যার যাকিছু ছিল তা নিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। এ যেন এক অভূতপূর্ব সম্প্রীতির বাংলাদেশের নজির স্থাপন হয়েছে। আবার প্রমাণ হলোÑ বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণসমাজ এ দেশের সকল প্রকার ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা-খরা, আপদ-বিপদ; সবই মোকবিলা করতে সক্ষম। জয়তু ছাত্র-তরণ-যুবসমাজ। এসব মানুষের সক্ষমতাকে ফিরিয়ে দিতে দুর্গত এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জরুরি কর্মসূচি নিতে হবে। বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন কাজের পরিকল্পনা হতে হবে যুগোপযোগী। ধীরগতিতে পানি নামার কারণে এসব জেলার অনেক স্থানেই বাড়ি ফেরার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি দুর্গত মানুষদের। ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহসাই পাঠদান শুরুর সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়াও বন্যার পানিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে ভবন ও আসবাব মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেরামত করা ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানই খোলা সম্ভব নয়। এসব স্কুল-মাদ্রাসা কবে খুলবে, কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছে না। তবে কিছু কিছু স্থানে বন্যা-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় অনেক শিক্ষাকেন্দ্রে শুরু হয়েছে শ্রেণিকার্যক্রম। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মেরামত করা জরুরি। কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে ও ভারত থেকে প্রবল পানি প্রবাহের কারণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত ছিল ৬৮টি উপজেলা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। মৃতের সংখ্যা শতাধিক। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫১ লাখ ৮ হাজার ২০২ জন। সার্বিকভাবে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরছেন।
বন্যা-পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে, বন্যা শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কার ও মেরামতকাজ শুরু করা দরকার। সাধারণত বন্যায় পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দেয়। এই অবস্থায় ডায়রিয়া, নানা রকম চর্মরোগসহ পতঙ্গবাহিত বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচার জন্য সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। প্রাণঘাতী বন্যায় মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গোটা দেশের মানুষ বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন নিয়ে চিন্তিত। প্রতিবছর বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও এবারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বন্যার পানিতে ডুবে গিয়ে নষ্ট হয়েছে স্কুলের আসবাব, বই-খাতাসহ শিক্ষা উপকরণ, ভবন, সীমানাপ্রাচীর ও নলকূপ। এসব কারণে পাঠদান শুরু করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে পাঠদান শুরু হলেও উপস্থিতি কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো চালু করা যায়নি। পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। যেগুলো পরিষ্কার হবে, সেগুলোতে পাঠদান করা হবে; কিন্তু বাচ্চাদের স্বাস্থ্যগত দিকটিও দেখতে হবে। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো দুর্গন্ধময় হয়ে রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে অনেক স্কুল ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। ফলে সেসব এলাকায় নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মতো বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য একত্র হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় এ ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা উচিত। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সরকার ও সর্বসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যায় বিপদগ্রস্ত এই পরিস্থিতি দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় আপামর জনতা। এবারের বন্যায় ২০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন করছে। বন্যায় কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে মূল কাজ। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ও জটিলও। যার কারণে প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও বরাদ্দ সবকিছু হলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি থেকে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত এতগুলো মানুষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকারকে পরিকল্পিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অসংখ্য নলকূপ নষ্ট হয়েছে, অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকাটি আসলে দীর্ঘ। ফলে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোকে আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আনতে আলাদা কোনও কমিশন গঠন করার কথা সরকারের বিবেচনা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
যে কমিশন সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগকে সমন্বয় করে পুনর্বাসনের কাজটি এগিয়ে নেবে। পুনর্বাসনের বিশাল এ কাজে অনিয়ম রোধেও সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ায় যাতে কোনও বৈষম্য তৈরি না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
লেখক : সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ