টেস্ট সিরিজ জয় : স্বপ্নের চেয়েও সুন্দরের এক গল্প

জাহিদ রহমান
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
টেস্ট সিরিজ জয় : স্বপ্নের চেয়েও সুন্দরের এক গল্প

আমাদের ৫১ বছরের খেলাধুলার ইতিহাসে বেদনা আর অশ্রুপাতের গল্পই বেশি। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমরা এখনো অনেক অনেক পিছিয়ে। ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিক্স- কোনোখানেই চোখে পড়ার মতো উন্নতি নেই। কখনো কখনো একটু-আধটু উন্নতি হলেও তা মিইয়ে যেতে সময় লাগে না। খোদ এশিয়ান লেভেলেই আমরা এখনও কল্পনার চেয়েও বেশি পিছিয়ে। আর বিশ্বকাপ, অলিম্পিকতো অনেক অনেক দূরে। এই যে কদিন আগে প্যারিস অলিম্পিক হয়ে গেল আমরা ফিরে এলাম একেবারে শূন্য হাতে। অথচ পাকিস্তান, ভারতের অ্যাথলেটরা স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়ে নিজ নিজ দেশকে গৌরবের আসনে বসিয়েছে। আমাদের সবেধন নীলমণিখ্যাত সাফ গেমসÑ সেখানেও এটা পাব ওটা পাব বলে স্বপ্ন দেখানো হলেও স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায় বার বার। কিন্তু এসব বেদনা ছাপিয়ে ক্রিকেটই আমাদের কাছে এক আনন্দমঞ্চ। যেখান থেকে প্রতিনিয়ত ভেসে আসে আনন্দধ্বনি। সেই আনন্দধ্বনিতে এবার যোগ হলো ‘টেস্ট সিরিজ’ জয়ের অনবদ্য এক গল্প। তাও প্রতিপক্ষের মাটিতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়ের মধ্যে দিয়ে সত্যিই ক্রিকেটে যেন তৈরি হলো নতুন আরেক জাগরণ।

টেস্ট ক্রিকেটে স্বপ্নের চেয়েও এত সুন্দর গল্প কখনই নির্মাণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু এবার সেই অধরা স্বপ্ন বাংলাদেশের ক্রীড়া ভুবনকে আলোকিত করেছে। তাও বিক্ষুব্ধময় এক নতুন বাংলাদেশের সময়ে। রক্তের স্রোত পেরিয়ে যে বাংলাদেশ এখন গুছিয়ে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। সেই সময়ে পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ ২-০ তে জয়লাভÑ ক্রিকেটের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহসী গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। ক্রিকেটীয় ভাষায় এটি হোয়াইট ওয়াশ বা ধবল ধোলাই। এতদিন বাংলাদেশের কাছে এটি ছিল মহা দুর্লভ বা বিরল এক বিষয়। হোয়াইট ওয়াশ বা ধবল ধোলাই এর আগে কাউকে করতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তানের মতো একটি দানবীয় ক্রিকেট শক্তিকে নিজ দেশের মাটিতে এভাবে পরাভূত করা ‘নতুন ইতিহাস’ ছাড়া আমরা আর কীইবা বলতে পারি।

পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ জয়লাভ করে ১০ উইকেটে। আর দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ৬ উইকেটে। দুটিই বড় ব্যবধানে জয়। দুটি টেস্ট ম্যাচ ব্যবচ্ছেদ করলে বাংলাদেশের প্রাপ্তির শেষ নেই। ভালো করে খেয়াল করুন দুটি জয়ই কিন্তু বাংলাদেশের জন্য নজিরবিহীন। তাও আবার দ্বিতীয় টেস্ট বৃষ্টির কারণে পাঁচ দিনের ম্যাচ হয় চারদিনে। সেখানেও বিস্ময়কর এক জয়। দ্বিতীয় টেস্টে পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে সব কটা উইকেট হারিয়ে করেছিল ২৭৪ রান। মেহেদী মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, সাকিব, নাহিদের বোলিং তোপে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা পূর্ণ রূপে নিজেদেরকে চিত্রিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। স্বভাবতই বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতেই তাই পাকিস্তানের বোলাররা ছিল ভীষণ আগ্রাসী। ২৬ রানে ৬ উইকেট খেয়েও ফেলেছিল। কি লিটন দাস (১৩৮) আর মেহেদী মিরাজ (৭৮) দ্বৈতকণ্ঠে এমন এক প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে অবশেষে বাংলাদেশের রান ২৬২-তে পৌঁছায়। জয়ের ভিত্তিটা তৈরি হয় এখান থেকেই। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানকে ভয়াবহ বিপদে ফেলে দুই তরুণ বোলার হাসান মাহমুদ আর নাহিদ রানা। ১৭২ রান করে অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। আসলে এ সময়ই বিজয় উঁকি দিতে থাকে বাংলাদেশ সীমানায়। ১৮৫ রানের টার্গেট নিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশের দুই ওপেনার জাকির এবং সাদমান। অবশেষে মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যানরাই নির্বিবাদে নির্বিঘ্নে খেলে জয় ঘরে তুলে নেয়। পাকিস্তানের লেগ স্পিনার আবরারের বলে সাকিব আল হাসান চারের মারটা মেরে টার্গেট ছুঁয়ে (১৮৫) বাংলাদেশের হাতে তুলে দেন বিজয়ের অপার আনন্দ। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে তরুণ বোলার হাসান মাহমুদ এবং নাহিদ রানা পাকিস্তানিদের উড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখেন। হাসান মাহমুদ নেন ৫ উইকেট। অন্যদিকে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন নাহিদ। এ দুজন এখনো ক্রীড়ামোদীদের কাছে ততটা চেনা নয়। তবে এবার তারা নিজেদেরকে চিনিয়েছেন ঠিকমতো। নাহিদ রানা তো ‘স্পিড মাস্টার’ খেতাব পাওয়ার পথে। ক্রিকেট আঙিনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই তরুণের আগমন খুব বেশি দিনের নয়। প্রথম শ্রেণির ঘরোয়া ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ২০২১ সালের অক্টোবরে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি এশিয়ান গেমসের জন্য গঠিত ক্রিকেট দলে অন্তর্ভুক্ত হন। এই টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তার অভিষেক ঘটে। অভিষেক ম্যাচেই তিনি দারুণভাবে জ্বলে উঠে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন। বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ের এই নতুন নায়ক দ্বিতীয় ইনিংসে ১১ ওভার বল করে ৪৪ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট নেন। তার বলের শক্তিশালী গতি ক্রিকেট বোদ্ধাদের নজর না কেড়ে পারেনি। বলা হচ্ছে দ্বিতীয় ইনিংসে তার বলের গতি ১৫২ কিলোমিটার পেরিয়ে গিয়েছিল। আর এই সিরিজে তার করা ৭০ শতাংশ বলের গতি ছিল ১৪০ কিলোমিটারের ওপরে।

বাংলাদেশ দলের তরুণ ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন শান্তকে ভীষণ ভাগ্যবান বললে ভুল হবে। বলতে হবে ‘সৌভাগ্যবান’। অধিনায়কের দায়িত্ব নেওয়ার পর এত দ্রুত তিনি এমন সব সাফল্য পাবেনÑ এ তো রীতিমতো কল্পনার বাইরের বিষয়। শান্ত তাই অশান্ত হয়ে উঠেছেন। আসুন তার কথা শুনি। টেস্ট সিরিজ জয়ের পর দীপ্তিময় কণ্ঠে বলেছেন, ‘এর পরের টার্গেট ভারত। ওখানেও আমরা পরিপূর্ণ টিমওয়ার্ক দেখাতে চাই।’ আর কদিন পরই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাচ। মানে রোহিত শর্মাদের মোকাবিলা করতে হবে তাকে। তিনি বলেছেন, ‘অভিজ্ঞ সাকিব, মুশফিক, মেহেদীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ভারতের সঙ্গে লড়ব।’ পাকিস্তানের মতো ভারতের সঙ্গেও দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ১৯-২৩ সেপ্টেম্বর চেন্নাই-এর চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে। দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর ভারতের কানপুরের গ্রিনপার্ক স্টেডিয়ামে। এই সফরে বাংলাদেশ দল তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও অংশ নেবে। পরিসংখ্যান বলছে এ পর্যন্ত মোট ১৩ জন ক্রিকেটার বাংলাদেশ টেস্ট দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই ১৩ জন হলেন নাঈমুর রহমান দুর্জয় (৭ ম্যাচ), খালেদ মাসুদ পাইলট (১২ ম্যাচ), খালেদ মাহমুদ সুজন (৯ ম্যাচ), হাবিবুল বাশার সুমন (২৮ ম্যাচ), মোহাম্মদ আশরাফুল (১৩ ম্যাচ), মাশরাফি বিন মর্তুজা (১ ম্যাচ), সাকিব আল হাসান (১৯ ম্যাচ), মুশফিকুর রহিম (৩৪ ম্যাচ), তামিম ইকবাল (১৩ ম্যাচ), মাহমুদ উল্লাহ (৬ ম্যাচ), মমিনুল হক (১৭ ম্যাচ), লিটন দাস (১ ম্যাচ) এবং নাজমুল হোসেন শান্ত (৬ ম্যাচ)। এর মধ্যে বেশি ম্যাচ জয়ের রেকর্ড মুশফিকুর রহিম এবং সাকিব আল হাসানের দখলে। তবে পরিসংখ্যানের বিচারে ব্যতিক্রম অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। এ পর্যন্ত মোট ৬টি টেস্ট ম্যাচের নেতৃত্ব দিয়ে জয় পেয়েছেন ৩টিতে। আর এই ৩টিতেই তিনি জয় পেয়েছেন প্রতিপক্ষের দেশের মাটিতে।

এদিকে নিজ দেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ পরাজয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের মুখ কালো হয়ে গেছে। সমালোচনার ঝড় উঠেছে চারদিকে। ক্রিকেটে কেন পাকিস্তানের এমন দশা এ নিয়ে চলছে বিস্তর বিশ্লেষণ। ঐতিহাসিকভাবেই ক্রিকেটের অন্যতম এক ‘পাওয়ার হাউজ’ বলে খ্যাত পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানকে হারিয়েতো বাংলাদেশ রীতিমতো অনুপ্রেরণার নতুন রসদ পেয়েছে। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান মহসীন নাকভী নিজ দেশের পরাজয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না। আর পাকিস্তানের দুই বিদেশি কোচ গ্যারি কারস্টেন এবং জেসন গিলেস্পি বলেছেন, ক্রিকেটারদের ফিটনেসটা জরুরি। আগামীতে এটা দেখতে হবে ভালোভাবে।

সবশেষে বলব, পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ জয়ের মধ্য দিয়ে যে নতুন ইতিহাস রচিত হলো সেটা ধরে রাখাটাই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমাদের কু-অভ্যাস হলো বিজয়ের আনন্দ বেশিদিন ধরে রাখতে না পারা। সেই ভয় ও সংশয় থেকে আমরা মুক্ত নই। সামনে ভারতের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ। ভুলে গেলে চলবে না ভারতের ব্যাটিং-বোলিং শক্তি কেমন। সুতরাং যে আনন্দের রঙ আজ বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তার ওপর যেন চরম ব্যর্থতার প্রলেপ না পড়ে। ভারতের বিপক্ষেও তাই আমাদের লড়তে হবে সর্বশক্তি আর দারুণ টিমওয়ার্ক দিয়ে। লড়াই আর জয়ের কথা তো এখন ঢাকার দেয়ালে দেয়ালেÑ ‘আমরা করব জয়।’


জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক এবং গবেষক,