কমলা-ট্রাম্পের জমজমাট লড়াই
আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কমলা হ্যারিসের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলেছে বিভিন্ন জনমত জরিপে। নির্বাচনের তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, ততই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। একই সঙ্গে একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনার তীর ছুড়ছেন। সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আসলে ভাবেননি, কমলা তার জন্য এত শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন।
অথচ মাস দুয়েক আগে যখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ভূমিধস বিজয়ের কথা বলা শুরু করেছিলেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বাইডেনের জায়গায় কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। ঝড়ের গতিতে বেড়েছে কমলার সমর্থন। বেশিরভাগ জনমত জরিপে তিনি ট্রাম্পকে পেছনে ফেলেছেন। সর্বশেষ ইউএস টুডের জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ডেমোক্রেটের কমলা হ্যারিস রিপাবলিকানের ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ৮ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। এর মধ্যে কমলা ভোট পেয়েছেন প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৩ শতাংশ। এর আগে ‘রয়টার্স’-এর জনমত সমীক্ষায়ও দেখা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে কমলা এগিয়ে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, মার্কিন দেশের সব জুয়ার প্ল্যাটফর্মেই সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে তাকে ধরে নেওয়া হচ্ছে, তার উপর বাজিও ধরছেন অধিকসংখ্যক মানুষ।
এমতাবস্থায় ট্রাম্প শিবির ব্যক্তিগত কুৎসা, এমনকি জাতিসত্তা সম্পর্কিত অস্ত্র দিয়ে কমলাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘রিপাবলিকান’ বনাম ‘ডেমোক্র্যাট’দের লড়াইয়ে, ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম কমলা হ্যারিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, অতি দক্ষিণপন্থীদের ‘আইকন’ নারী চ্যালেঞ্জারের জাতিসত্তা বা ‘আইডেনটিটি’কেই প্রচারের মূল বিষয় করে তোলা হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় মা ও জামাইকান বাবার সন্তান কমলা হ্যারিস কোন পরিচয়টাকে সামনে আনতে চান সেই প্রশ্ন তুলে সরাসরি কটাক্ষ করেছেন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের শাড়ি পরিহিত পুরনো ছবি, যা আসলে দক্ষিণ ভারতে তার মাতামহসহ অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে এক ফ্রেমে থাকার স্মৃতি, সেটিকেও জনসমক্ষে এনে বিতর্ককে খুঁচিয়ে দিতে চেয়েছেন।
আকস্মিক জো বাইডেনের চেয়ে অনেক কম বয়সি প্রতিদ্বন্দ্বী চলে আসায় এবং তার সমর্থনের পারদ উপরে ওঠায় ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে অস্থিরতায় ভুগছেন। সমাজে জেন্ডার ইস্যু একটি জটিল বিষয়। এই জটিলতা হিলারির ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে কাজ করেছে। তবে ধারণা করা যায়, কমলার ক্ষেত্রে বিষয়টি বিপরীত হবে। কমলার মিশ্র জাত, অভিবাসীর সন্তান হিসেবে পরিচয়, শ্বেতাঙ্গ পুরুষের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোর মানুষকে আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে অভিবাসীদের। আমেরিকার পশ্চিমে কমলার একটা গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি রয়েছে। তিনি ওই এলাকারই মানুষ। দক্ষিণেও পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টাবে না। কারণ কমলার মধ্যে রোজকার আমেরিকানের একটা ইমেজ রয়েছে। তাইতো মার্কিন মুলুকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্ধারক হিসেবে পরিচিত ‘সুইং স্টেট’ বা বিভিন্ন ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড স্টেট’-এ কমলা হ্যারিস এগিয়ে রয়েছেন।
আরও পড়ুন:
গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যাচ্ছে কেন
আমেরিকার নির্বাচনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা নির্দিষ্ট ধরন আছে। ৫০টি প্রদেশের মধ্যে যেগুলো ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকে থাকে, সেগুলো ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকেই জেতায়, ভোটের পরিভাষায় যাদের বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’। এর বিপরীতে আছে ‘রেড স্টেট’, অর্থাৎ যে-প্রদেশগুলোতে রিপাবলিকানদের দাপট বেশি, সেই রাজ্যের ভোট যায় রিপাবলিকান প্রার্থীর অনুকূলে। দুই শিবিরের এই ভাগাভাগির মধ্যে থাকে ‘সুইং স্টেট’গুলো। নির্বাচনে তারা যেদিকে ঝোঁকে, সেই দলের প্রার্থী হোয়াইট হাউসে পৌঁছে যায়।
জো বাইডেন যত দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন, তত দিন এগারোটি ‘সুইং স্টেট’-এ তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু ‘বাইডেনের পরিবর্তে কমলার আগমনের পর এই চিত্র বদলে গেছে। পাঁচটি ‘সুইং স্টেট’-এ কমলা হ্যারিস এগিয়ে গিয়েছেন, চারটিতে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান প্রার্থী সমান-সমান অবস্থানে রয়েছেন, আর দুটিতে এগিয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্বভাবতই লক্ষণ ভালো নয় বুঝেই হয়তো কমলা হ্যারিসের জাতিসত্তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশ্ন করছেন, অ-শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের নিজের দিকে টানার চেষ্টায়।
অবশ্য ৫৯ বছর বয়সি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসও চমৎকার জবাব দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রাজনীতিকে ট্রাম্প কোন পথে প্রবাহিত করতে চান, তা আন্দাজ করে নিয়েই দক্ষ আইনজীবী এবং জেরার জন্য বিখ্যাত হ্যারিস সরাসরি ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এই বলে যে, ‘সাহস থাকলে যা বলার আমার মুখের উপর বলুন। মুখোমুখি বিতর্কে আসুন।’ হ্যারিসের নাম ঘোষণার পর থেকেই যেভাবে ডেমোক্র্যাট শিবির চাঙ্গা হয়ে মাঠে নেমেছে, যেভাবে অনুদানের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তাতে এমনিতেই রিপাবলিকান শিবির শঙ্কিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প যাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছেন, সেই জেমস ডেভিড ভান্স তো কবুলই করে নিয়েছেন ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী বদলে যাওয়া তাদের জন্য বড় ধাক্কা। ট্রাম্প-সহযোগীর এই স্বীকারোক্তি হয়তো প্রত্যাশিতই ছিল, কারণ তার নিজের ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রী এতদিন ডেমোক্র্যাটদের ঘোরতর সমর্থক ছিলেন। ট্রাম্প বা রিপাবলিকান নেতৃত্ব হয়তো আশা করেছিল, ভান্স পারিবারিক যোগাযোগ প্রয়োগ করে আমেরিকায় দক্ষিণ-এশীয় বংশোদ্ভূতদের ভোট টানতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন। কিন্তু কমলা হ্যারিসের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে যাওয়া এশিয়া বা আরব বংশোদ্ভূতদের মধ্যে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা তৈরি করেছে, তা অবশ্যই ভান্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করবে।
এর উপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্রমাগত কমলা হ্যারিসকে ব্যক্তিগত আক্রমণ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের তো বটেই, নারী ভোটারদেরও একাট্টা করে ডেমোক্র্যাটদের ছাতার তলায় নিয়ে আসতে পারেÑ রিপাবলিকান দলের ভোট ম্যানেজাররা ইতোমধ্যে এমনই আশঙ্কা করছেন।
আরও পড়ুন:
বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
ট্রাম্প বনাম হ্যারিসের লড়াই যখন হতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বের রাজনীতি এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। নড়বড়ে জো বাইডেন, বর্তমান ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট, অবশ্য বিদায় জানানোর আগে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গিয়েছেন, যার জন্য ইতিহাস তাকে মনে রাখবে। ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’-র পরে রাশিয়ার সঙ্গে সর্ববৃহৎ বন্দি বিনিময় সেরে তিনি অবশ্যই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাটদের বলার জন্য বড় অস্ত্র দিয়ে গিয়েছেন। এই যে ২৬ জন বন্দি পুতিনের দেশ থেকে ছাড়া পেয়ে তুরস্ক হয়ে মার্কিন মুলুকে পা রেখেছে, তাদের স্বাগত জানাতে জো বাইডেন তো শুধু একা যাননি, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন কমলা হ্যারিসকেও যাতে জোর গলায় হ্যারিস বলতে পারেন, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর ইভান গ্রেসকোভিচসহ বাকি বন্দিদের রুশ কারাগার থেকে মুক্ত করে আনার মতো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ডেমোক্র্যাটরাই নিতে পারে। আমেরিকার রাজনীতিতে ২০১৬ সাল থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘রুশ মিত্র’ পুতিনের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। অতএব, যে দল বা যে রাজনীতিক মস্কোর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন, তিনি তো মার্কিন ভোটারদের কাছে বাড়তি নম্বর পেতেই পারেন পাবেন, সেটাই কাক্সিক্ষত।
সম্প্রতি এক নির্বাচনী প্রচারণা সভায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কমলা হ্যারিস সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই নারী যা করেন, জেনেশুনেই করেন। আমি আশ্বস্ত করছিÑ যদি কমলা হ্যারিসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন, তাহলে এটিই হবে আপনার সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত। প্রশ্ন হলো, রক্ষণশীল আমেরিকানরা কি এবার নারী প্রার্থীকে জিতিয়ে নতুন ‘সেরা সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করবেন? নাকি উগ্র মেজাজি আমেরিকা ফাস্ট স্লোগানধারী ট্রাম্পকে বিজয়ী করে ‘রক্ষণশীলতা’কেই ধরে রাখবেন?
বিশ্বের এক চরম সন্ধিক্ষণে এবার আমেরিকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের দীর্ঘায়িত যুদ্ধের পাশাপাশি গাজার ধ্বংসলীলা, বা ইসরায়েল বনাম ইরানের ‘ছায়াযুদ্ধ’ কখন সত্যিকারের যুদ্ধের চেহারা নিয়ে নেয়, তা নিয়েও বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে ‘অতি দক্ষিণপন্থী’ ট্রাম্প নাকি ঠাণ্ডা মাথার ‘নেগোশিয়েটর’ কমলা হ্যারিস মার্কিন ভোটারদের পছন্দের বেশি মানুষ হবেন, তা জানতে আরও প্রায় দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুন:
নিঃশব্দ আততায়ী কালো ধোঁয়া
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক