আমার নদী ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও খাল
গত ১৯ আগস্ট থেকে টানা বৃষ্টি আর উজানের দেশ থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হতে থাকে দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত এসব জেলার অর্ধশতাধিক মানুষ এই বন্যায় প্রাণ হারিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখের বেশি।
এবারের স্মরণকালের বড় বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, লক্ষ্মীপুর। ভারত আগাম বার্তা না দেওয়ায় সাধারণ মানুষকে সচেতন করা যায়নি। এতে ক্ষতি বেড়েছে বহুগুণ। ভারত যদি আগাম বার্তা দিত এবং আমাদের তরফ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে আমাদের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা ক্ষতি কমানো যেত এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই কারও। এ কথাও সবাই জানেন যে, পানির ধর্ম নিচের দিকে নেমে আসা। তাই আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এবারের এ বন্যা ঠেকানোর কোনো উপায় ছিল না। তবে আমরা যদি আন্তর্জাতিক নদী অধিকার নিয়ে কথা বলি ও সরকার এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারব। যাতে ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার অক্ষুণœ থাকে।
আন্তর্জাতিক নদীর হিস্যা নিয়ে সবাই কথা বলছেন। আমি আরেকটা বিষয়ে কথা বলতে চাই, সেটা হলো আমাদের নদীগুলোর সংরক্ষণ নিয়ে। আমাদের নদীগুলোর অধিকার নিয়ে। তার আগে এই বন্যার ব্যাপার থেকে আমরা একটু পেছনে যাই। ফিরে যাই শৈশবে। যারা অন্তত ৯০-এর দশক দেখেছি তাদের স্মরণ থাকবে দেশের নদ-নদীগুলো আগে কেমন ছিল আর এখন কেমন অবস্থায় আছে। আমাদের কবিরা যে প্রমত্তা নদীগুলোর কথা কবিতায় লিখেছেন সেগুলো এখন কেমন আছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রা নিয়ে কবিতা লিখেছেন, কাব্য গ্রন্থ লিখেছেন। চিত্রা নামে কবিগুরুর একটি বোটও ছিল, পদ্মা নামে আরও একটা বোট ছিল। এসব বোটে করে তিনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পাতিসরসহ নদীমাতৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলার প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বার বার উঠে এসেছে রূপসা, ধানসিঁড়ি, জলসিঁড়ি, শিপ্রা, ধলেশ্বরী, চিলাই, কালিদহ, কীর্তিনাশার মতো বিভিন্ন নদীর নাম। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা জুড়ে আছে ধানসিঁড়ি, কপোতাক্ষ নদীর উল্লেখ। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানসহ সেকাল-একালের সব কবির কলমে প্রেম কিংবা বিরহের মতো উঠে এসেছে নদীমাতৃক দেশের নদীগুলোর নাম। লিখেছেন নদীর প্রেম নিয়ে। নদীর রূপ নিয়ে, এমনকি নদীর অর্থনীতি নিয়েও। কবিদের কলমের অন্যতম বড় খোরাক এই নদীগুলো এখন আর ভালো নেই। কোথাও জমেছে চর, কোথাও দখল হতে হতে হয়েছে খাল। আবার কোথাও নেই নদীর কোনো অস্তিত্ব। দখল হয়ে নদী হয়েছে নগর, হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা।
কপোতাক্ষ কিংবা ফেনী নদীতে এখন আর সাঁতার কাটার সুযোগ নেই। দখল দূষণে দেশের অধিকাংশ নদী আর সাধারণ ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। আমাদের শৈশবের নদীগুলো যদি অক্ষত থাকত তাহলে অন্তত বন্যার পানি কিছুটা দ্রুত নেমে যেতে পারত।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
১৫৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ফেনী নদী বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফেনী হয়ে এটি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। তবে ফেনীর যে অংশ দিয়ে এটি সাগরে মিশেছে সেই অংশের নাম কিন্তু নদী না, প্রজেক্ট! মহুরী প্রজেক্ট নামেই এটি সাগরে মিশেছে। আমাদের নদী এখানে তার পরিচয়ই হারিয়ে ফেলল।
উচ্চ আদালত থেকে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দেশের সব নদ-নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ বা জীবন্ত সত্তা হিসেবে রায় দেওয়া হয়। সে বছর ৬ জুলাই পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয় বাংলাদেশের নদীগুলো মানুষের মতো আইনি অধিকার পাবে। আইন অনুযায়ী নদী এখন ‘জুরিসটিক পারসন’। এই রায়ের মধ্য দিয়ে নদীগুলোর অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। নদী মানুষের মতো অধিকার পাবে। নদীদূষণ ও দখলকারী মানবজাতির হত্যাকারী হিসেবে বিবেচিত হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। নদীর এই স্বীকৃতি অবশ্য বাংলাদেশে প্রথম নয়, ২০১৭ সালে কলম্বিয়ার সাংবিধানিক আদালত সে দেশের ‘রিয়ো এট্রাটো’ নামক নদীকে এই স্বীকৃতি দেয়।
আদালত থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও দেশের নদীগুলোর সংখ্যা ও নাম নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১০০৮টি, আর বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী জানা গেছে- দেশে নদী-উপনদী মিলিয়ে মোট সংখ্যা ৭০০টি। তবে এসব পরিসংখ্যান মানতে নারাজ নদী গবেষকরা। নদী গবেষক ও নদী রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক রংপুর বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘আমাদের নদীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০০০’। যারা নদী নিয়ে কাজ করেন তাদের অধিকাংশই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আমাদের নদীগুলোকে প্রধানত হত্যা করা হয়েছে স্বীকৃতি না দিয়ে। খালকে বলা হয় নদীর নার্ভ। দেশের সব নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল ভরাট করে অথবা স্লুইসগেট নির্মাণ করে নদীকে আস্তে আস্তে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ নদীতে যে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো নদীর প্রস্থের থেকে অনেক কম। এতে নদী বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। দখলদারদের দখল করতে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সব শেষে নদীর নাম খাল, লেক কিংবা প্রজেক্ট ঘোষণা দিয়ে নদীর সত্তাই বিলুপ্ত করা হয়েছে।
আমাদের হারিয়ে যাওয়া নদী-খাল পুনরুদ্ধার করে স্বীকৃতি দেওয়া না হলে ভবিষ্যৎ আরও ভয়াবহ হবে। বিশ^ব্যাপী যে জলবায়ু সংকট দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলা করার জন্য আন্তর্জাতিক বড় বড় সমস্যা সমাধান যেমন জরুরি, তেমনি আমাদের ছোট ছোট খাল ও নালাগুলোর যতœ নেওয়াও সমান জরুরি। সচেতন হতে হবে আমাদের ঘর থেকে গ্রামের ছোট নদী থেকে। আগাম সতর্কতা পেলে যাতে পানির প্রবাহ অবাধে সাগরে চলে যেতে পারে, সেজন্য আমাদের নদী-খাল-জলাশয় দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
শাখাওয়াত উল্লাহ : গণমাধ্যম ও পরিবেশ উন্নয়নকর্মী