স্বাস্থ্য খাতে দরকার ব্যাপক সংস্কার

মৌলি আজাদ
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্বাস্থ্য খাতে দরকার ব্যাপক সংস্কার

নতুন বাংলাদেশ গড়তে সমাজের উঁচু থেকে নিচু- সকলেই ব্যস্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। এত বছরের জঞ্জাল সরানো সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ কাজ। তার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতটা সম্ভব ধীরে ধীরে সংস্কারের কাজ করছে। আশা করা যায় তারা তাদের কাজে সফল হবেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের দিকেই সকলের মূলত দৃষ্টি; কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ত এই ডামাডোলে অনেকের নজরে আসছে না।

২৪ আগস্ট দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে- ‘চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ : রংপুরে এক হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় চার নবজাতকের মৃত্যু’। অনেকেই হয়ত বলবেন দেশের বড় বড় সমস্যার পাশে এ আর এমন কী সমস্যা? কথা হলো যেই পরিবারে একজন মা ৯ মাস গর্ভধারণের পর যখন সন্তানের মুখ দেখার আশায় থাকেন, তখন যদি প্রসূতির মৃত্যু বা নবজাতকের মৃত্যু হয়; সে পরিস্থিতিতে একজন মায়ের কী অবস্থা হতে পারে তা সেই দুঃখিনী মা ছাড়া কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব না। রংপুরের হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় শিশুদের যে মৃত্যু হলো এর দায় কে নেবে? আমাদের দেশে চিকিৎসকের অবহেলায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। বহুবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ইতিপূর্বে কোনো হাসপাতাল এ কারণে দায় নেয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। কিছু দিন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে হটটক হয়, তার পর সবাই ভুলে যায়। এমনকি দেখা যায় চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোও চিকিৎসকদের অপরাধের শাস্তি না চেয়ে বরং তাদের রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো দায় নেয় না। চিকিৎসকের অপরাধ অনুযায়ী কোনো শাস্তি হয় না। বরঞ্চ শিশুর ক্ষেত্রে এনআইসিইউ ও বড়দের ক্ষেত্রে আইসিইউ-এর ভাড়া বাবদ লাখ লাখ টাকা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক নেওয়া হয়। পুরো ব্যাপারটায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় রোগীর পক্ষের লোকজন। তাই কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু চলছেই। কিছু কিছু ক্লিনিক ও চিকিৎসক রোগীর অবহেলায় মৃত্যুর বিষয়টি সিরিয়াসলি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাবোধ করে না। তাদের কাছে এ যেন ছেলেখেলা।

সরকারি অনেক হাসপাতালে খোঁজ নিলে এমন সব ঘটনা বের হবে, যা শুনলে বা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে গেলে সিট পাওয়া যায় না। আয়া, নার্স, এটেনডেন্টরা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দুর্বব্যবহার করেন। তাদের অনেকেই টাকা না দিলে রোগীর দিকে তাকায় না। সরকারি হাসপাতালগুলোর বাথরুমগুলো যেন জাহান্নাম। পুরুষের চেয়ে নারীরা বাথরুম ব্যবহারে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হন, কারণ পুরুষ রোগীর এটেনডেন্ট হিসেবে নারীরাই সাধারণত হাসপাতালে থাকেন। বাথরুমের খারাপ অবস্থার কারণে তারা বাথরুমে যান না, এর ফলে ইউরিন ইনফেকশনের শিকার হন তারা। এমন নয় যে, হাসপাতালে বাথরুম পরিষ্কারের জন্য কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। সবই আছে; কিন্তু কার নির্দেশে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে না সেটা দেখার বিষয়। খাবারের ক্যান্টিনও থাকে অপরিষ্কার। শোনা যায় সরকারি হাসপাতালের দালালরা রোগী ভাগিয়ে তাদের পরিচিত ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সরকারি হাসপাতালে মানুষ যায় সস্তা-বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়ার জন্য; কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে হয়। এক্সরে, সিটিস্ক্যান, মেমোগ্রাফি করার যন্ত্রগুলো বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে। তাই রোগীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও ছুটতে হয় বাইরের দামি ক্লিনিকে।

অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আকাশ ছোঁয়া দাম দেখা যায়। কীভাবে এই দাম নির্ধারিত হয় তা আমরা জানি না। দেখা যায় কয়েক ঘণ্টা যদি বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তি থাকে, তা হলেও তার বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। যদি সে হাসপাতালে ভর্তি, এইচডিইউ, আইসিইউতে থাকে তা হলে পাঁচ লাখ টাকার নিচে বিল পরিশোধ না করে বাসায় ফিরতে পারে না।

ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয়বহুল, আমরা সকলেই জানি। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরা ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত সরকারি হাসপাতালেই যান। টিভির একটি রিপোর্ট থেকে জানলামÑ সেখানেও কেমোথেরাপি নিতে তাদের ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। সেটি নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে কীভাবে বহন করা সম্ভব? তা হলে তো বলতে হয়Ñ ক্যানসার বা কিডনির অসুখ হলে নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগীদের মৃত্যুপানে চেয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগীদের চিকিৎসা মানেই হলো পরিবারটি আর্থিক অসচ্ছলতায় পতিত হওয়া। একমাত্র উচ্চবিত্ত ছাড়া দুরারোগ্য এসব অসুখে আমাদের দেশের সকলের অবস্থা অতি শোচনীয়।

তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর উল্লিখিত অনিয়মের দিকে নজর দেওয়া দরকার। বাংলাদেশের বয়স এখন ৫৩ বছর। দেশের স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনাগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আমলে না নেয়, তবে তা হয়তো আর কখনই ঠিক হবে না। এখন স্বাস্থ্য খাতে যেসব বিষয় দেখা দরকার তা হলোÑ

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ফি কীভাবে নির্ধারণ হচ্ছে তা মনিটরিং করা দরকার।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে অর্থ বরাদ্দ থাকার পরও কেন সকল রোগী যথাযথ সেবা পায় না, সে বিষয়টি দেখার জন্য কমিটি গঠন করা দরকার।

ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের রোগীদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় চিকিৎসকদের ন্যায্য ফি নির্ধারণ করতে হবে।

সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের দুর্নীতিগ্রস্ত আয়া, নার্স, এটেনডেন্টদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তির ব্যবস্থা করে না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

যেসব চিকিৎসকের অবহেলায় বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে তাদের তালিকা করা দরকার। তারা যেন কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক দলের সাপোর্ট না পান; সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

আর কতকাল আমাদের দেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে? আর কতকাল চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যু হলেও সাধারণ জনতা কোনো প্রতিকার পাব না? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যুক্ত আছে দেশের তরুণ সমাজ। তরুণরাই পারবে হাসপাতালগুলো তাদের নজরদারিতে রাখতে। অতিসত্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন উপরোক্ত বিষয়গুলো নজরে আনে ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। আমজনতা পদে পদে হাসপাতালে গিয়ে আর দুর্ভোগ পোহাতে চায় না।

নতুন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত হতে হবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে সাজানো। স্বাস্থ্য খাতে আর কোনো দুর্নীতি জনগণ দেখতে চায় না। বাধ্য হয়ে জনগণ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যায়। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য যদি নতুন করে আইন/বিধি/অধ্যাদেশ জারি/প্রণয়ন করা দরকার হয়, তা হলে সে পদক্ষেপও সরকারের নেওয়া দরকার।


মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক