৩৬ জুলাই গণবিপ্লব, বিজয় ও সেনাবাহিনী
‘মা আপনি আমার কোলে ওঠেন, আপনার পায়ে যেন ময়লা পানি না লাগে, আপনি শুধু আমার কাঁধে ভর দিয়ে থাকবেন, আমি তো আপনার সন্তানের মতোন।’
সদ্য বন্যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২ মাস চাকরির একজন লেফটেন্যান্ট (নেট দুনিয়ায় ছবিটি ভাইরাল) একজন বৃদ্ধ মাকে নির্দ্বিধায় পাঁজাকোলে করে নিয়ে গেল নিরাপদ আশ্রয়ে।
সেই বৃদ্ধ মা জননীর উত্তর- “বাপজান আমার ছেলেরাও আমাকে কোনোদিন কোলে নেয় নাই। তুমি নিলে। আবার ‘মা’ বলেও ডাকলে?”
‘তোমাকে একটু ভালো করে দেখি। আর তোমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই বাবা।’
এই বাচ্চা লেফটেন্যান্টের মতো অফিসার তো বৃদ্ধ মাকে নয়, সমগ্র বাংলাদেশকে কাঁধে নেওয়ার মতো সাহস ও মনোবল রাখে।
আমরা বিনিদ্র জেগে থাকব। আমৃত্যু দেখে রাখব। সুখে না হোক, দুঃখে পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
প্রিয় বাংলাদেশ- সালাম ও শুভ সকাল।
৩৬ জুলাই ২০২৪ তথা ৫ আগস্ট ২০২৪। সূচিত হলো এক নতুন বাংলাদেশ। স্বাধীন হলো বাংলাদেশ স্বৈরাচারের হাত থেকে। ছাত্র-জনতার মিলিত মাসব্যাপী আন্দোলন পরিণত হলো বিপ্লবে। পরাজিত হলো ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার অধ্যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হতে শুরু। সমাপ্তি একদফা আন্দোলন। ছাত্রদের এই আন্দোলনে শরিক হন তাদের বাবা-মা, চাচা-চাচি, নানা-নানি, দাদা-দাদি, ভাই-বোন। অতঃপর বাংলাদেশের সব স্তরের জনগণের রাজপথে নেমে আসার অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা। এমন আন্দোলন পৃথিবীতে নজিরবিহীন। গিনিসবুকে স্থান করে নিল এই বিপ্লব। দেশীয় গণ্ডি ছেড়ে আজ এই আন্দোলন বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। পাকিস্তানে ছাত্র-জনতার বর্তমান আন্দোলনে যখন ৩৬ জুলাই বিপ্লবের স্লোগান ও বাংলাদেশের পতাকা দেখি, তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়।
৫ আগস্ট ২০২৪-এ অনেককেই বলতে শুনেছি- আজ তাজা নিঃশ^াস নিতে পারছি। ভয়ডর ছাড়া কথা বলতে পারছি। ’৭১-এর শহীদরা আজ নিশ্চয়ই শান্তিতে ঘুমাবেন কবরে।
গণ অভ্যুত্থান আমরা দেখলাম। একবার নয়, কয়েকবার- ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, স্বাধীন বাংলাদেশের কল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য আমাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশ ‘স্বাধীন’ করেছি। স্বাধীন করেছি কি আসলে? নাকি ইসলামাবাদের জায়গায় দিল্লির পরাধীন হয়েছি?
তবে আজকের চিত্রটা নিশ্চয়ই ভিন্ন। আমরা আজ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন। আমি বলি আসল স্বাধীনতা কী আজ আমরা তা অনুধাবন করতে অভ্যস্ত হচ্ছি এবং ভবিষ্যতে আরও হবো ইনশাআল্লাহ।
এই স্বাধীনতা ও বিপ্লবের জন্য প্রশংসা বাংলাদেশের আপামর সব মুক্তিকামী জনতার। বিশেষ করে ছাত্রদের যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাকে বাংলাদেশকে এক অভিন্ন গন্তব্য তথা বিজয়ে অংশগ্রহণ করাতে পেরেছে, যা দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল পারেনি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক হিসেবে ঝধষঁঃব জানাই আমাদের আগামীর এই সূর্যসন্তানদের। অনেকেই তাদের আখ্যা দিই এবহ-ত বলে, যা একটি করপোরেট শব্দ। আমি তাদের আখ্যা দিতে চাই জড়ুধষ ইবহমধষ ঞরমবৎং ড়ভ ইধহমষধফবংয.
৩৬ জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা : বাংলাদেশ সম্ভবত বিশে^র একমাত্র দেশ, যারা পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হতে ১৯৭১ সালে গঠন করে সশস্ত্র বাহিনী এবং তার পর যুদ্ধ করে স্বৈরাচার পাক হানাদারদের বিপক্ষে। সে সময় আমাদের সেনাবাহিনী শুরু করে সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র যুদ্ধ। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও জেনারেল নুর উদ্দিনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী জনতার বিপক্ষে যায়নি। এবার ২০২৪ গণ অভ্যুত্থানেও জেনারেল ওয়াকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
জনগণের বিপক্ষে যেতে অস্বীকার করায় স্বৈরাচার ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়।
বুকে হাত দিয়ে বলি ৪ আগস্ট কিংবা জুলাই মাসেও আপনারা কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন এই ১ মাসের মাঝে স্বৈরাচারের এভাবে পতন হবে?
গত ১৬ বছরে বহু আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ৫ মে মতিঝিলের হেফাজত আন্দোলনে হাজার হাজার লাশ পড়ার পরও যখন স্বৈরাচার টিকে যায়, তখন হতাশা তো দানা বাঁধারই কথা। বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন বীর সেনানীর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জনগণের ভরসার কেন্দ্রস্থল সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠী সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে দুঃশাসন ও নির্যাতনের হাইওয়েতে যাত্রা শুরু করে।
ফেরত আসি এবারের বিজয়ে : ১/১১ এবং বর্তমান ২০২৪-এর সেনাবাহিনীর বিজয়-পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে। তার আগে এই দুটি পর্বে মৌলিক পার্থক্য না বুঝলে অনেকেরই ১/১১-এর জেনারেল মইনউদ্দিন-পরবর্তী সরকার ছিল সেনা সমর্থিত সরকার। মইনউদ্দিন ছিলেন উচ্চাভিলাষী এক জঘন্য ব্যক্তি। কিন্তু ২০২৪-এর জেনারেল ওয়াকার ঠিক তার উল্টো স্বভাবের।
আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও ১৯৯২-৯৪ বগুড়া সেনানিবাসে একসঙ্গে চাকরির সুবাদে তাকে ভালো করে চিনি। তখন তিনি ছিলেন একজন মেজর। অতঃপর যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়ে আজ বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। জেনারেল মইনউদ্দিন আহমেদের সঙ্গেও আমার ২০০০ সালে রংপুর ডিভিশনে চাকরি করার অভিজ্ঞতা আছে। সাধারণত যা হয়, পদোন্নতি পেলে মানুষের চরিত্র বদলে যায়, যা মইনউদ্দিন আহমেদের বেলায় দেখেছি।
অথচ জেনারেল ওয়াকারের মাঝে তা আজ অবধি দেখিনি। তার বাবা একজন ডিস্ট্রিক্ট জজ ছিলেন। ওয়াকার স্যার একজন অসম্ভব সৎ, পরহেজগার ও নীতিবান মানুষ। তার মাঝে অহংকার ও উচ্চাকাক্সক্ষা একদম অনুপস্থিত। তার বাবার মতো নীতির সব গুণাগুণ তিনি পেয়েছেন।
অনেকেই তাকে নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি শেখ হাসিনার আত্মীয় বলে সেনাপ্রধান হতে পেরেছেন। আমরা যারা সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছি তাদের অভিমত ওয়াকার স্যার ও যে ৩-৪ জন সেনাপ্রধান হওয়ার দৌড়ে অগ্রগামী ছিলেন তার মাঝে জেনারেল ওয়াকার সর্বোচ্চ মার্ক পাওয়ার যোগ্য।
২০২৪-এ এই গণ অভ্যুত্থানে তার ভূমিকা তাকে ইতিহাস বানিয়ে ফেলেছে। সেনাবাহিনী যে বাংলাদেশের জনগণের- এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কীই বা হতে পারে? তিনি তো পারতেন ক্ষমতা নিতে সে সময়। কিন্তু নেননি। বরং জনগণের ইচ্ছাশক্তিকে সম্মান দেখিয়ে ড. ইউনূস সরকারের কাছে ক্ষমতা স্বেচ্ছায় দিয়ে যেন তার কাঁধে ন্যস্ত দায়িত্ব সঠিকভাবে হস্তান্তর করেন। অনেককে বলতে শুনি ৩৬ জুলাই ২০২৪-পরবর্তী বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে মৃদু সমালোচনা করতে। চলুন এটা নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করি।
ড. ইউনূস সরকারকেও ইতোমধ্যে অনেকে সমালোচনা করা শুরু করেছেন। একবার ভাবুন তো দীর্ঘ ১৬ বছরের জঞ্জাল কীভাবে তারা ১৬ দিনে ঠিক করবেন। ফেরেশতাদের ক্ষমতা দিলেও কি এটা সম্ভব?
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুলিশ বাহিনী কর্তব্যযজ্ঞে হাওয়া হওয়ায় দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি কি ভুলে গেছি? অতঃপর পেলাম প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে উপহারস্বরূপ ভয়াবহ বন্যা। তার পর আনসার বিদ্রোহ।
প্রশাসন ও বিভিন্ন সেক্টরে ঘাপটি মেরে থাকা বিগত স্বৈরাচার দোসররা পদে পদে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণে সচেষ্ট। জুডিশিয়াল ক্যু সামলাতে হলো বর্তমান সরকারকে। ভবিষ্যতে গন্ধ পাচ্ছি আরও ষড়যন্ত্রের। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির কথা বাদই দিলাম।
এ অবস্থায় চিন্তা করুন তো- আপনার হাতে ক্ষমতা থাকলে কী করতেন।
আল্লাহর রহমত সিপাহি-জনতার ঐকমত্য ও ইচ্ছার কাছে পরাজিত হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা। তবে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। সামনে আমাদের আরও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের সব অর্গান তথা প্রশাসন ও বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে আশু প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। কেবল কোনো বিশেষ বাহিনী প্রধান বদলালে কার্যকর ভূমিকা আশা করা বোকামি। কারণ সংস্থায় পুরনো লোকগুলো কিন্তু তলে তলে কলকাঠি যে নাড়ছে, তা সর্বশেষ আনসার বিদ্রোহে প্রমাণ পাওয়া যায়।
তাহলে আমাদের করণীয় কী?
১. ষড়যন্ত্রকারী যারা ইতোমধ্যে চিহ্নিত, তাদের অবিলম্বে বরখাস্ত করা যেতে পারে।
২. যেসব ষড়যন্ত্রকারী এখনো ঝঁৎভধপবফ হয়নি, অথচ ষড়যন্ত্র করতে পারে, তাদের বের করে অনুরূপ বরখাস্ত করা। এটা খুব কঠিন কাজ নয়। দেশের জনগণ বেশির ভাগ ষড়যন্ত্রকারীকেই চেনে।
৩. ড. ইউনূস সরকারকে আরও শক্ত হতে অনুরোধ করছি। আপনারা আমাদের আশার আলো। আপনারা বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি। আপনারা রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা নন। আপনারা বিপ্লবের ফসল তথা বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের প্রতিনিধি।
৪. ড. ইউনূস স্যার- আপনার হাতে সশস্ত্র বাহিনী, আপনি আমাদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, আপনি তালিকা করে ষড়যন্ত্রকারীদের অপসারণে সেনাবাহিনীকে আদেশ করুন। তারা তা পালনে বাধ্য।
৫. যেভাবে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে বরখাস্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেভাবে ‘আয়নাঘর’-এর উদ্ভাবক সাবেক ডিজিএফআই প্রধান লে. জেনারেল আকবরকে (বর্তমানে এলপিআর) অবিলম্বে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করে বরখাস্ত করুন।
৬. সংস্কার যেহেতু হচ্ছেই, তাই বাংলাদেশের স্বার্থে সেনাবাহিনী প্রধানের সহায়তায় নিজের ঘর থেকেই চালু করুন অবিলম্বে। গুটিকতক দলবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত লোকজনের পাপের দাগে সমগ্র সেনাবাহিনীর কলঙ্কমোচনে আমরা আপনার কাছে অভিভাবক হিসেবে দাবি বা আবদার করছি। তবে সামরিক বাহিনীতে সংস্কার হতে হবে ধাপে ধাপে, আচমকা নয়।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
৭. ভবিষ্যতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ১ বছরের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত। জাতীয় দুর্যোগ বা বহির্শক্তির আক্রমণে এই প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা ’৭১-এর আপামর মুক্তিযোদ্ধাস্বরূপ বাংলাদেশের এক বিশাল শক্তিতে পরিণত হবে।
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে অনেক কিছু করার আছে। অনেকেই অনেক আগ্রহ নিয়ে সরকারকে উপদেশ দিচ্ছেন এবং সরকারও আন্তরিকভাবে তা গ্রহণ করছে। তবে আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং সরকারকে কাজ করতে সময় দিতে হবে।
আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে উপরোক্ত প্রস্তাবনা রাখলাম, যা ষড়যন্ত্র নস্যাতে সহায়ক হবে বলে মনে করি। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলার মানোন্নয়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা লোকজন ভয় পাবে। ড. ইউনূস ও তার দল তাদের নিজ নিজ ফিল্ডে পরীক্ষিত সফল। তাই বাকিটা তারা চালিয়ে নেবেন এটা নিশ্চিত। পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী এই গণবিপ্লবে নিহত ও আহত সব শহীদ, তাদের পরিবার ও ছাত্র-জনতাকে উৎসর্গ করছি আমাদের ভালোবাস ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
পানি লাগবে পানি? শহীদ মুগ্ধের সেই চিত্রের কথা লিখতে চোখে আজও জল আসে।
শহীদ আসাদ- তুমি বাংলাদেশ। তুমি আমাদের গর্ব- তুমি বিশে^ বাংলাদেশকে নিয়ে গেছো এক অন্য উচ্চতায়।
তোমাকে সশস্ত্র সালাম।
আহমেদ ফেরদৌস : মেজর (অব.) ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক