ভারত-বাংলাদেশ পানিবণ্টন সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন
বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে, সীমান্তের উভয় পাশের নদী কয়েক দিন আগে চরম পর্যায়ে প্লাবিত হওয়ায় কমপক্ষে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে বন্যায় প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে শত শত বাড়ি পানির নিচে চলে গেছে, বাসিন্দারা ছাদে আটকা পড়েছে। বন্যায় অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং বাংলাদেশের বন্যাকবলিত এলাকা থেকে ২ লাখের বেশি লোককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সংবাদ অনুযায়ী বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশে প্রবল ভারতবিরোধী মনোভাব বিরাজ করছে। এর অন্যতম মূল কারণ হলো শেখ হাসিনাকে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখতে ভারতের দ্ব্যার্থহীন সমর্থন। এর সঙ্গে রয়েছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্যান্য অস্থিরতা যার মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন অতিগুরুত্ব বহন করে। চলমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা, ছাত্ররা এবং অন্যান্য মহল যথাযথভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই অসন্তোষের প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশকে না জানিয়ে বাঁধের কপাট খুলে দেওয়া যার ফলে বাংলাদেশ এই ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে। ত্রিপুরা বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার ফলে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি হওয়ার অপবাদ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণেই এমনটা হয়েছে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, ভারতের দাবি সত্য বলেই মনে হচ্ছে। এই বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বন্যার সম্ভাব্য কারণ আর এই বৃষ্টিপাত ভারতেও বন্যার উদ্রেক করেছে। এরই সঙ্গে, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদদের অক্ষমতা এবং ভারত বাঁধের গেট খোলার বিষয়ে যোগাযোগ না করাটাও বিশাল ত্রুটি বলেই বিবেচ্য। এসব বিবেচনার পাশাপাশি, এটিও অস্বীকার করা যায় না যে, নদীর উজানে ভারতের সুবিধাজনক অবস্থান, পূর্ববর্তী শাসনামল থেকে অর্জিত রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সুবিধা এবং বর্তমান বিন্যাসে পানি বণ্টন চুক্তি থেকে যে তির্যক সুবিধা পরিস্থিতি ভারতের অনুকূলেই প্রবাহমান রেখেছে। বাংলাদেশ এখন যে রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে এ দেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব অতি স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বন্যার মতো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথভাবে একটি উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছেন। কিন্তু সম্প্রতি বন্যা পরিস্থিতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর প্রতি পুনরায় গুরুত্বারোপ করার ইঙ্গিত বহন করে।
তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তির মাধ্যমে তিস্তার পানির ন্যায়সঙ্গত বণ্টন চেয়েছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তিস্তা একটি অসমাপ্ত প্রকল্প হিসেবেই রয়ে গেছে, কারণ পৃথক রাজ্যগুলো ভারতে আন্তঃসীমান্ত চুক্তিগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন চুক্তির ৩০ বছরের মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং তার সরকার ২০২৬ সালে ভারতের সঙ্গে চুক্তি নবায়নের আলোচনার চেষ্টা করছিলেন। বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি এবং আঞ্চলিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গতিশীলতার পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিবর্তন বিবেচনায়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থাও বিবেচনা করতে হবে। পানি বণ্টন ও নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলো এ পর্যন্ত অকার্যকর বা সর্বোপরি ভারতের অনুকূলেই প্রতীয়মান। বাংলাদেশের অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক প্রয়াস অব্যাহত রাখা উচিত; কিন্তু দ্বিপাক্ষিক প্রয়াসই বাংলাদেশের একমাত্র অবলম্বন হওয়া উচিত নয়। ভারত সর্বদাই সব সমস্যা ও ইস্যু দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের প্রতি জোর দিয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। যৌথ নদী কমিশন এবং গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি তার অন্যতম প্রধান উদাহরণ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
যৌথ নদী কমিশন আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার মূলে ভারতের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বড় প্রদায়ক। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত এবং সম্ভবত কূটনৈতিক ও কৌশলগত অক্ষমতা এই কমিশনের ব্যর্থতার অপর বড় নিয়ামক। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন। এর অর্থ এই নয় যে, দেশটিকে তার সংবিধানে নিবিষ্ট পররাষ্ট্রনীতি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। বাংলাদেশের সাংবিধানিক পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বের যে কোনো দেশের একই নীতির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে উদার এবং প্রশংসনীয়। তবে, রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে বাংলাদেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে এই বৈদেশিক নীতি কীভাবে প্রয়োগ করা হয় তা পুনর্নির্মাণ করা দরকার। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বহাল থাকায়, বাংলাদেশের জন্য উল্লিখিত বৈদেশিক নীতি প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ণয় করার এটাই উপযুক্ত সুযোগ।
বাংলাদেশকে অবশ্যই ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন এবং আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনার সমাধানে তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততা বিবেচনা করতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। ভারত ও পাকিস্তান ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০-এ বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিটি সিন্ধু নদী ব্যবস্থার পানি ব্যবহার করার বিষয়ে উভয় দেশের বাধ্যবাধকতা এবং অধিকারগুলোকে নির্ণয় ও প্রতিষ্ঠিত করে। সিন্ধু পানি চুক্তিকে সবচেয়ে সফল বৈশ্বিক আন্তঃসীমান্ত পানি বণ্টন চুক্তি এবং একটি স্থায়ী দ্বিপাক্ষিক আস্থা-নির্মাণ পরিমাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিন্ধু পানি চুক্তির মধ্যে একটি কার্যকরী বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। চুক্তিটির বাস্তবায়ন অবশ্যই প্রতিনিয়ত অনেক সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কিন্তু এই চুক্তিটির মধ্যে অধিষ্ঠিত বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য কার্যকর পন্থা সরবরাহ করে। বাংলাদেশকে অবশ্যই এই ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে একটি অনুরূপ চুক্তি স্থাপনের কথা বিবেচনা করতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিমের তিনটি নদীর পানি পাকিস্তান এবং পূর্বের তিন নদীর পানি ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন ন্যস্ত করা হয়। এই উদাহরণ প্রেক্ষিতে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। সিন্ধু চুক্তির মতো একটি পন্থা আমাদের জন্য কার্যকরী প্রমাণিত হতে পারে।
বাংলাদেশকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনব্যবস্থার অধীনস্থ বিদ্যমান প্রক্রিয়াও অনুসরণ করতে হবে, যেমনটি সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পানি আইন আন্তর্জাতিক চুক্তি, দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক অববাহিকা চুক্তি এবং নীতিগুলো নিয়ে গঠিত। আন্তর্জাতিক আইন পানির বিরোধ এড়াতে বা নিষ্পত্তি করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি প্রদান করে। এই আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে বেশ কয়েকটি সার্বজনীন নীতি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, যুক্তিসঙ্গত এবং ন্যায়সঙ্গত পানি ব্যবহারের নীতি, উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করার বাধ্যবাধকতা এবং পরিবেশগত ব্যবস্থায় সহযোগিতা ও রক্ষা করার দায়িত্ব নিহিত করা। জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক শিকার এবং তাৎপর্যপূর্ণ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা ভারত ও বাংলাদেশের জন্য পানি বণ্টন ব্যবস্থার জন্য এগুলো প্রয়োজনীয়। সুতরাং, বাংলাদেশের এই আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করাও জরুরি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এছাড়াও বাংলাদেশকে অবশ্যই উদ্ভূত সমস্যার ঘরোয়া ও স্বকীয় সমাধান অনুসরণ করতে হবে। পানি বণ্টনে ভারতের অকার্যকারিতা কিংবা অনীহার কারণেই বাংলাদেশ তিস্তা নদীর বৃহৎ অংশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং নদীপৃষ্ঠ ড্রেজিং করার চৈনিক প্রস্তাব বিবেচনা করা শুরু করে। কিন্তু ভারতের অপারগতা ও উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ চীনের প্রস্তাব বাতিল করে বাংলাদেশ। এ রকমটা তৎকালীন সরকার রাজনৈতিক বিবেচনাতেই করে। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক গভীর এবং বিস্তর অর্থনৈতিক বাণিজ্যের ওপর অধিষ্ঠিত। যেহেতু, এখন আর রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের প্রধান পথপ্রদর্শক, তাই বাংলাদেশের আবারও চীনের প্রস্তাব বিবেচনা করা উচিত।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা কোনোভাবেই উপরিল্লিখিত আলোচনার লক্ষ্য নয়। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং সংযোগ অকাট্য সত্য এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ পরিক্রমায়ও এর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত, ভূ-অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তবতা যা বাংলাদেশ কখনই উপেক্ষা করতে পারে না। তবে, এই সম্পর্কের পরিক্রমা এ পর্যন্ত মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন সেই দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ দ্বারা এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পরিক্রমা অতিক্রম করা। ভারতকে বুঝতে হবে যে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের জন্য চিরকাল অপেক্ষা করবে না বরং অন্য বিকল্পের সন্ধান করবে। এটাই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সাইমন মোহসিন : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক