টেস্ট জয় : ক্রীড়াঙ্গনে আরও ছড়িয়ে পড়–ক নতুন স্বপ্নের রঙ

জাহিদ রহমান
২৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
টেস্ট জয় : ক্রীড়াঙ্গনে আরও ছড়িয়ে পড়–ক নতুন স্বপ্নের রঙ

২১ আগস্ট নাজমুল হাসান পাপন যুগের অবসান শেষে ক্রিকেট বোর্ডের নতুন সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এবং সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। ক্রিকেটাঙ্গনে ফারুক আহমেদ বরাবরই চৌকস, বুদ্ধিদীপ্ত এক নাম। ফলে তাকে চিনতে বা বুঝতে কাউকে কষ্ট হচ্ছিল না। ফারুক আহমেদ সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় অভিনন্দিত হন চারপাশ থেকে। তবে তিনি বেশি অভিনন্দিত হন ক্রিকেটের এক নিবেদিত মানুষ হওয়ার কারণে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ক্রোধান্বিত ক্রীড়া অনুরাগীরা চাচ্ছিলেন বিসিবির সভাপতি পদে বহুদিন আঁকড়ে থাকা নাজমুল হাসান পাপনের মুখ থেকে যেন আর কথিত মধুময় শব্দ শুনতে না হয়। আর এ কারণেই উত্তেজনাময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই ফারুক আহমেদের আগমন জনমনে স্বস্তি ও নতুন এক স্বপ্নের রঙ ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেই রঙ যে রক্তাক্ত আগস্টকে আরও নতুন করে দ্রুত রাঙিয়ে দেবে, তা বোধহয় কারও কল্পনাতেই ছিল না। ফারুক আহমেদ যেদিন দায়িত্বপ্রাপ্ত হন সেদিনই পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম টেস্ট খেলতে নামে বাংলাদেশ। টেস্ট ম্যাচে প্রতিপক্ষ পাকিস্তান আর দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আলোচনা বা আড্ডায় ক্রিকেট ছিল না বললেই চলে। কিন্তু পঞ্চম দিনে বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই অবিশ্বাস্য এক জয় করায়ত্ত করে বাংলার আকাশকে নতুনভাবে রাঙিয়ে তোলে। ক্রিকেটের এই সাফল্যে যেন দেয়ালে দেয়ালে তরুণ প্রজন্মের লেখা নতুন নতুন সব গ্রিফিতির সাহসী শব্দই প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। ওই যে ‘আমরা করব জয়’, ‘আমরাও পারি’, ‘শোনো মহাজন, আমরা বহুজন’, এ রকম আরও কত কী!

পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচে এতকাল আমাদের কোনো জয় ছিল না। এবারই প্রথম, তাও দশ উইকেটের চকচকে জয়। তবে এই ঐতিহাসিক জয়ে মুশফিক ও মিরাজের পর বড় এক অবদান রেখেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার আলোচিত-সমালোচিত সাকিব আল হাসান। মুশফিক প্রথম ইনিংসে অনবদ্য আলোকোজ্জ্বল ১৯১ রান করে জয়ের স্বপ্নটা আকাশে উড়িয়েছিলেন সবার আগে। তার আত্মবিশ্বাসী ইনিংসের কারণেই বাংলাদেশ ম্যাচটা ধরে রাখে নিজেদের হাতের মুঠিতে। এই ম্যাচে অভিজ্ঞ মুশফিকের অনন্য নিবেদন ক্রীড়ামোদীদের মনে থাকবে অনেক অনেকদিন। তবে ১০ উইকেটে হারার পর পাকিস্তানের হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে। পুরনো খেলোয়াড়রা এই হার নিয়ে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করছেন। পাকিস্তানের সাবেক তারকা ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদি বলেছেন, ‘সচেতনতার অভাবের কারণেই পাকিস্তান হেরেছে।’ প্রতিবেশী ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা বলেছে, প্রথম ইনিংসে ডিক্লেয়ার করে ১০ উইকেটে এর আগে পরাজিত হওয়ার নজির ছিল ভারতের। সে ঘটনা ৪০ বছর আগের, অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংস্টনে ভারত প্রথম ইনিংসে ৩০৬ রানে ডিক্লেয়ার করে। এর পর প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করে ৩৯১ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নামে ৯১ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত। অতঃপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের লক্ষ্যে মাত্র ১৩ রান তাড়া করতে হয়। ফলে অনায়াসেই মাত্র ১০ উইকেটে জয়লাভ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টেস্ট ম্যাচে প্রথমে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে পরাজয়ের ঘটনা ঘটেছে মোট ২৬ বার। ক্রিকেটে এই ধরনের পরাজয়ের শুরুটা ১৯৬১ সালে। আর অনেকদিন পর এসে সেভাবে হারল পাকিস্তান।

এদিকে ক্রিকেট মাঠের সবচেয়ে বিতর্কিক তারকা সাকিব আল হাসান খুনের মামলা মাথায় নিয়েও এই আলোচিত ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট মুঠোবন্দি করে বাংলাদেশের জয়কে ত্বরান্বিত করতে বড় ভূমিকা রাখেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৭ ওভারে তিনি ৪৪ রান দেন। তবে পাকিস্তানের ওপেনার আব্দুল্লাহ, সৌদ শাকিল এবং নাসিম শাহকে তিনি আউট করেন। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডিতে যখন সাকিব খেলছিলেন তখন আইনের দৃষ্টিতে তিনি একজন খুনের আসামি হয়েই খেলছিলেন। গত ২২ আগস্ট ঢাকার পোশাককর্মী রুবেল হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলার বাদী রুবেলের বাবা রফিকুল ইসলাম। মামলায় ২৮ নম্বর আসামি করা হয়েছে সাকিবকে। তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে হত্যা মামলার আসামি করায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি ক্রীড়ানুরাগীরা। কেননা ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনে সাকিব দেশেই ছিলেন না। তিনি তখন কানাডাতে ছিলেন। ওখান থেকেই তিনি পাকিস্তানে গিয়ে দলের সঙ্গে যোগ দেন। তবে এ কথা সত্য, এই মামলার কারণে সাকিবের ক্রিকেট ক্যারিয়ার যে মহা এক সংকটের কবলে পড়েছে তা বলাই বাহুল্য। যে কোনো সময় তাই সাকিবকে দল থেকে প্রত্যাহার করা হতে পারে। কিন্তু সাকিবের নামে মামলা দায়ের করার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো বার্তা দেবে না। সাকিব সমসাময়িক সময়ে রাজনীতিতে জড়ালেও খেলার মাঠে সাকিব বরাবরই নিবেদিত এক প্রাণ। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক অনেক প্রাপ্তির গল্পের তিনি অন্যতম অনুঘটক। তবু বলতেই হয় রাজনীতি বলে কথা।

বিশ্বময় পরিচিত ক্রিকেট বিশ্লেষক উৎপল শুভ্র পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ম্যাচ জয় সম্পর্কে বলেছেন, ‘রূপকথার মতো এক জয়’। আসলেও তাই। বিচার-বিশ্লেষণ আর পরিসংখ্যানে সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে। টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের জয়ের পাল্লা তেমন ভারী নয়। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত খেলে ফেলেছে মোট ১৪৩টি টেস্ট ম্যাচ। এর মধ্যে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে মোট ২০টি ম্যাচে। ড্র করতে পেরেছে ১৮টি টেস্ট ম্যাচে। বাদবাকি ১০৫টি ম্যাচে পরাজিত হতে হয়েছে। জয়ের শতকরা হার মাত্র ১৩.৯৮। পরিসংখ্যান বলছে, টেস্ট খেলুড়ে দেশের সবাইকে বাংলাদেশ হারাতে পারলেও এখন পর্যন্ত ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মোট ১৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে মাত্র দুটিতে ড্র করতে সক্ষম হয়েছে, বাদবাকিগুলোতে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও ফলাফলটা এ রকমই। মোট ১৪টি টেস্ট ম্যাচে ড্র এসেছে মাত্র দুটিতে। বাদবাকিগুলোতে পরাজিত হতে হয়েছে।

স্মরণে আনুন ঘরের মাঠে বাংলাদেশের সেই প্রথম টেস্টের পর গড়িয়ে গেছে কত কত বছর। টেস্টে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অভিষেক ঘটেছিল ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায়। ১০-১৩ নভেম্বর হওয়া এই টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছিল ৯ উইকেটে। টেস্ট ম্যাচের ইতিহাসে এটি ছিল ১৫১২তম ম্যাচ। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। প্রথম রানটি আসে শাহরিয়ার হোসেনের ব্যাট থেকে। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ আমিনুল ইসলাম বুলবুলের দুর্দান্ত ১৪৫ রানের সুবাদে মোট ৪০০ রান করে। এরপর সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ভারত খেলতে নেমে করে ৪২৯ রান। পরের ইনিংসে বাংলাদেশ দল মাত্র ৯১ রানে গুটিয়ে গেলে ভারতের জন্য জয় সহজ হয়ে পড়ে। ৬৩ রানের টার্গেট তাই সহজেই পার করে ভারত। এই টেস্টে অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় ৬ উইকেট পেয়েছিলেন। তবে সব বিচারে বুলবুলের সেঞ্চুরিটা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি করার অনন্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি।

এই মাসে বাংলাদেশ কত কিছুই না পেল। নতুন এক বাংলাদেশের সঙ্গে এলো আকস্মিক বন্যা। বন্যার সঙ্গে এলো পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে ঐতিহাসিক এক বিজয়। এই জয়ের সৌরভ না ফুরাতেই সাফ অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলে ভারতের বিপক্ষে টাইব্রেকারে জয় নিয়ে এলো আরও এক নতুন সুবাস। ক্রিকেট-ফুটবলের লড়াইয়ে এই অনন্য প্রাপ্তি, নতুন এই আশার আলো আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য সত্যিই এক নতুন সুবাতাস। আসলেই রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ, দুর্নীতি আর চাটুকারমুক্ত ক্রীড়াঙ্গন প্রতিষ্ঠিত হলে অমূল্য এসব প্রাপ্তি আরও আসতে বাধ্য। নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই ক্রীড়াঙ্গনে আরও ছড়িয়ে পড়–ক নতুন স্বপ্নের রঙ।


জাহিদ রহমান : ক্রীড়ালেখক ও গবেষক