স্মরণ : গোলাম মুরশিদ
২০ আগস্ট, ২০২৪, বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টায় যখন আমি ফোন করলাম তখন আর স্যার কথা বলতে পারলেন না। স্যারের স্ত্রী এলিজা মুরশিদ ফোন ধরে বললেন, ‘হসপিটালেই আছি মাহফুজা, তোমার স্যারের অবস্থা ভালো না।’ ২২ আগস্ট ২০২৪, স্যার চলে গেলেন। লন্ডনের কুইন্স হসপিটালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মাসখানেক আগেও হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলার সময় স্যার বলেছিলেন, ‘দেশে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার স্বাস্থ্য ভালো না। এলিজাও ক্যানসারের রোগী। কী করে আসব বল? আর কি দেশে ফেরা হবে!’ দেশে ফেরা হলো না আর! লিখছি গবেষক গোলাম মুরশিদের কথা। এক জীবনে বাংলা সাহিত্যকে তিনি অনেক দিয়েছেন, দিয়েছেন বাংলাদেশকেও।
বাংলা জীবনী সাহিত্যে তিনি এনেছেন নতুনত্ব। জীবনী সাহিত্য বলতে কী বোঝায়, জীবনী লিখতে হলে কেমন করে লিখতে হয়, তাতে কী কী থাকতে হয়, তা গোলাম মুরশিদ বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন। তার মধুসূদন-জীবনী আশার ছলনে ভুলি এবং নজরুল-জীবনী বিদ্রোহী রণক্লান্ত সে সাক্ষ্য দেয়। তাছাড়া তিনি ছিলেন ‘সত্যসন্ধানী’ গবেষক। তার গবেষণায় কোনো ফাঁক রাখতেন না। তার মুখে এমনও শুনেছি, ‘এক সময় বাঙালি সংস্কৃতিতে এ রকম ছিল, কিন্তু এখন এ রকম হয়ে গেছে। তাই আমার হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিটা রিভাইজ করব।’ হ্যাঁ, তিনি রিভাইজ করতে পেরেছেন। এতে বোঝা যায় তিনি কোনো অসম্পূর্ণ তথ্য পাঠকের সামনে রাখতে চাননি। এভাবে তিনি নিজের অনেক বই-ই সংস্কার করেছেন। তার গবেষণা কালান্তরে বাংলা গদ্য (১৯৯৩) বা ঔপনিবেশিক আমলের বাংলা গদ্য : উন্মেষ ও বিকাশের ইতিহাস (২০১৭) বাংলা গদ্যের ইতিহাস রচনায় নতুন পথ দেখিয়েছে। তার আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী, নারী প্রগতির একশো বছর : রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া, নারী ধর্ম ইত্যাদি বইগুলোতে নারীর অতীত-বর্তমান অবস্থা, সংগ্রাম, এগিয়ে চলায় বাধা-বিপত্তি ইত্যাদি এত স্পষ্ট এবং নির্মোহভাবে দেখানো হয়েছে যে, সিনেমেটিক ছবির মতো চোখের সামনে দৃশ্যগুলো ভেসে ওঠে। ‘বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য’ বইটি সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এবং যারা বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে চান, তাদের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় একটি বই হিসেবে বেঁচে রইল। তার লেখা প্রায় পঁয়ত্রিশটি বই বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে রইল। তার সম্পাদিত বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান একটি মাইলফলক।
অনেকেই হয়তো জানেন না এই গবেষক মানুষটি গানও গাইতেন। এমনকি গানের শিক্ষক পর্যন্ত ছিলেন। তার ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শিল্পী। দেশ-বিদেশের কত বিখ্যাত গানের ক্যাসেট, সিডি যে তার সংগ্রহে ছিল! দেবব্রত বিশ্বাসের ‘দূর হতে এসো কাছে’ নামক দুটি সিডির ৩২টি গান গোলাম মুরশিদ নিজে নিজের রেকর্ডারে রেকর্ড করেছিলেন ১৯৭৩ সালে, যা ২০১২ সালে স্মারক অ্যালবাম হিসেবে প্রকাশিত হয়। যেমন গান গাইতেন, গানের সমঝদার ছিলেন, তেমনি গানের ইতিহাসও কম জানতেন না। তার বাংলা গানের ইতিহাস গান সম্পর্কে একটি দলিল বললে ভুল বলা হয় না। স্যার যখন এ লেখাটি ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় লিখছিলেন, তখন এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করতেন ফোনে এবং প্রকাশ হওয়ার পর জিজ্ঞাসা করতেন, ‘সহজপাঠ্য হয়েছে তো? সাধারণের বোধগম্য হয়েছে তো? তোমার কী মনে হয়?’ হ্যাঁ মুরশিদ স্যার খুব সহজভাবেই লিখতেন। যেন এক লাইন পড়লে আরেক লাইন পড়তে ইচ্ছে করে। যেন কোনো বেগ পেতে না হয়। যেন ভাষাই পাঠককে পড়ার ভেতরে নিয়ে যায়। স্যার যখন লিখতেন সেটা নিয়ে আলোচনা করতেন আমাদের সঙ্গে। একটা অধ্যায় লিখে মেইল করে মতামতও চাইতেন। এত বড় একজন পণ্ডিত ব্যক্তি আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের সঙ্গে লেখার আলোচনা করেছেন- এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বিদ্রোহী রণক্লান্ত লিখবার সময় একবার বলেছিলেন, ‘একটা চ্যাপ্টার শেষ করেছি। এখন এটা বার বার পড়ে ভাষাটা সহজ করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত কানে সহজ-সুন্দর না শোনাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা ঠিক করতেই থাকব। যখন কিছু লিখবে, বার বার নিজে পড়বে, দেখবে নিজের কাছেই অনেক ভুল ধরা পড়বে- শব্দের ভুল, অর্থগত ভুল, বাক্যে ভুল।’Ñ এমন আরও কত কত শিক্ষা স্যারের কাছে পেয়েছি!
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শুরু করেছিলেন নিজের জীবনী লেখা। প্রথম দিকে তিনি অবশ্য বলতেন, ‘আমার জীবনী লিখে কি হবে? আমি কি তেমন কেউ!’ তবু আমরা কয়েকজন মিলে তাকে রাজি করিয়েছিলাম লিখতে। তা আর শেষ হলো না! বেশ কিছুদিন থেকে তিনি লিখতে পারছিলেন না। কিছুদিন আগে মেঝেতে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছিলেন, তারপর হার্টের অসুখ, ব্লাড প্রেসার ওঠা-নামা করছিল, পারকিনসন্স হয়েছিল, জীবনসঙ্গী এলিজা মুরশিদের অসুস্থতাÑ সবকিছু মিলিয়ে লেখাটা বন্ধ ছিল। কিন্তু আশা ছিল তিনি শেষ করতে পারবেন। হলো না!
মানবধর্মে বিশ্বাসী গোলাম মুরশিদ বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমত মানুষ, দ্বিতীয়ত মানুষ এবং শেষ পর্যন্ত মানুষ।’ মানুষের কল্যাণের জন্য তার ভাবনা ছিল আকাশ সমান। তিনি ন্যায়-নীতিতে ছিলেন অবিচল, নিয়ম-নিষ্ঠায় কঠোর, সত্য-ভাবনায় আপোষহীন। বলেছিলেন, ‘যখন লিখতে পারব না, তখন যেন মরে যাই।’ তাই হলো! সৃষ্টিকর্তা তার কথা বৃথা যেতে দিলেন না। বাংলা সাহিত্য হারালো নীরব এবং একনিষ্ঠ এক সেবককে। বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
মাহফুজা হিলালী : সহযোগী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!