স্বাস্থ্য খাত পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ প্রয়োজন

ডা. মো. ছায়েদুল হক
২৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্বাস্থ্য খাত পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ প্রয়োজন

স্বাস্থ্যসেবা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটি জাতি-গোষ্ঠীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা দেখেই বলে দেওয়া যায় জাতি হিসেবে সেটি কতটুকু উন্নত। নিরবচ্ছিন্ন কর্মক্ষমতা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যক্তি অথবা সমষ্টির জন্য অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ কাজ নয়। আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যায় এটি বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কমই সরকারগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। একটা সময় দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ছিল নিতান্তই ক্ষীণ। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় অনেক হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চিকিৎসাসেবা প্রদানে প্রয়োজনীয় জনবল যেমনÑ নার্স, প্যারামেডিকস টেকনিশিয়ান ইত্যাদি তৈরিতেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যবসার মনোবৃত্তি অধিকতর ক্রিয়াশীল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিশেষ করে জনবল তৈরিতে মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত। বিপরীত চিত্র হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলো বেশ এগিয়ে। তবে এখানে চিকিৎসা ব্যয় সাধারণের নাগালের বাইরে থাকায় দেশের সচ্ছল ছোট একটি অংশ এখানকার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে সমর্থ্য হয়ে থাকে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসামান অনেকটাই পিছিয়ে থাকলেও দেশব্যাপী এর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত থাকায় সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল হলো সরকারি হাসপাতাল। তবে রোগ প্রতিরোধ এবং গবেষণার বিষয়টি সরকারি এবং বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই চরমভাবে উপেক্ষিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চিত্র একদম বেহাল না বললেও দুর্দশাগ্রস্ত বলাই যায়। এখান থেকে স্বাস্থ্যখাতকে উদ্ধার করতে হলে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে যার অনেকটাই বেশ চ্যালেঞ্জিং এবং অজনপ্রিয়। অপ্রতুল বিনিয়োগ এবং দুর্বল স্বাস্থ্যপ্রশাসন হলো দুটি ক্ষত যা স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারগুলোকে নিরুৎসাহিত করে আসছে।

বর্তমান সরকারটি একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রেক্ষিত বিবেচনায় এটি গতানুগতিক সরকার থেকে ভিন্ন মাত্রার একটি সরকার যার কাছে সাধারণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বি। এই প্রত্যাশার একটি আলোকিত দিক হলো এই সরকারের যে কোনো পদক্ষেপকে সাধারণ মানুষ স্বাগত জানাবে, কারণ তারা আমূল পরিবর্তন চায়। যেহেতু নিকট অতীতে গতানুগতিক ধারার সরকার তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তারা তাদের প্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছাতে যে কোনো পরিবর্তনকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। স্বাস্থ্য খাতটি সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি খাত। বর্তমান সরকারের উচিত এই খাতটিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনির্মাণে পদক্ষেপ নেওয়া। কাঠামোগত পরিবর্তনের চেয়ে ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনে অধিকতর গুরুত্বারোপ করা জরুরি। দু-একটি বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই, যেগুলো অগ্রাধিকার বিবেচনার যোগ্য।

প্রথমেই আসা যেতে পারে চিকিৎসাসেবা প্রদানের বিষয়ে। দেশে শহর থেকে গ্রাম অব্দি স্বাস্থ্য অবকাঠামো বিস্তৃত। এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক দিক। বিপরীতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সাধারণ প্রচলিত বিশেষায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নেই বললেই চলে। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ থাকলেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে বিশেষায়িত চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর দ্রুত আধুনিকায়ন জরুরি। বিশেষ করে নিরাপদ প্রসব এবং সিজারিয়ান সেকশনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা, রোড ট্রাফিক এক্সিডেন্ট ও যে কোনো ইমারজেন্সি হলে তার প্রাথমিক চিকিৎসা এবং জেলা হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজগুলোতে দ্রুত রোগী পরিবহন সিস্টেম গড়ে তোলা খুবই জরুরি। সেকেন্ডারি বা জেলা পর্যায়ের জেনারেল হাসপাতাল এমনকি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অনেক জেলাতেই আছে। জেনারেল হাসপাতালগুলোকে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে বিশেষ করে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসার নিমিত্তে করোনারি কেয়ার ইউনিটসহ যে কোনো ইমারজেন্সি ব্যবস্থাসম্বলিত সুযোগ-সুবিধা, নিরাপদ প্রসবের জন্য এন্টিনেটাল কেয়ার, সিজারিয়ান অপারেশনসহ স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও সব ধরনের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বিশেষায়িত হাসপাতাল যেমন- জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় মানসিক হাসপাতাল, ক্যানসার ইনস্টিটিউট, ইউরোলোজি এবং কিডনি হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউটের মতো আরও যেসব বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে সেগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে রূপান্তরিত করে এবং ছোট কলেবরে এগুলোর শাখা বিভাগীয় শহরগুলোতে করতে পারলে বিশেষায়িত চিকিৎসা আরও বিস্তৃত ও কার্যকরী করা সম্ভব। করপোরেটগুলো যাতে বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোতে বাধ্যতামূলক চেইন হাসপাতালের ব্যবস্থা করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলো কেবল এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী টিচিং হাসপাতাল হিসেবে রাখা যেতে পারে। ন্যূনতম একটি রেফারেল সিস্টেম খুবই প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেহাল এবং রুগ্ন চেহারার অধিকারী হলো মেডিক্যাল এডুকেশন বা চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা। বিশেষ করে নিকট অতীতে কোটারি বিবেচনায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার যে মহোৎসব শুরু হয়েছে তাতে চিকিৎসা শিক্ষার মান দ্রুত নিম্নগামী হতে দেখা যায়। মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে ন্যূনতম প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো ভীষণ রকম বাণিজ্যনির্ভর হয়ে পড়ে। অবকাঠামোগত দুর্বলতা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় অপ্রতুলতা, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, দুর্বল বেতন কাঠামো ও অপ্রতুল লজিস্টিক সাপোর্ট এবং অস্বচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া মেডিক্যাল এডুকেশনকে প্রায় প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলো অধিকাংশই অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে এবং এদের অনেকেই নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে থোড়াই কেয়ার করতে দেখা যায়। মেডিক্যাল কলেজগুলোকে মাননিয়ন্ত্রণে বাধ্য করতে, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো যেমন বিএমডিসি, মেডিক্যাল এডুকেশন, মেডিক্যাল ফেকাল্টি অব ডিন এগুলোকে আরও ক্ষমতায়ন করতে হবে, মন্ত্রণালয় বা সরকারের প্রভাব কমিয়ে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করতে পারলে এবং যেনতেনভাবে মুনাফার মনোবৃত্তি থেকে কলেজ মালিকদের কিছুটা নিরুৎসাহিত করতে পারলেই কেবল এখান থেকে উত্তরণ সম্ভব। মানহীন মেডিক্যাল কলেজের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশে চিকিৎসা ব্যয় একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যয় রোগীকে নিজ পকেট থেকে নির্বাহ করতে হয়। চিকিৎসা ব্যয় কমাতে হলে প্রথমত স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ওষুধের দাম কমাতে হবে। প্রয়োজনে ট্যাক্স সুবিধা দিয়ে এবং যৌক্তিকভাবে ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা নিলে ওষুধ সামগ্রীর দাম কমে আসবে। এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসনের সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষায়িত চিকিৎসা সাধারণের নাগালে আনতে হলে সরকারের বিনিয়োগের কলেবর বাড়াতে হবে। যেমনÑ হাসপাতালের অবকাঠামো সরকার করে দিতে পারে অথবা লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে কেবল ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে এক ধরনের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে চিকিৎসা খরচ অনেক কমে যাবে এবং চিকিৎসার মানও উন্নীত হবে।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় বিদেশি হাসপাতালের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারের এক ধরনের বিনিয়োগ থাকতে হবে যাতে ব্যয় সাধারণের নাগালে থাকে এবং এটিকে অবশ্যই স্বায়ত্তশাসিত ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত করতে হবে। চিকিৎসাসেবার বাইরেও স্বাস্থ্য খাতে অবহেলিত খাত হলো জনস্বাস্থ্য। রোগ প্রতিরোধকল্পে সাধারণের মাঝে সচেতনতা এবং রোগ প্রতিরোধে সমাজে বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা নেওয়া খুবই প্রয়োজন।

মেডিক্যাল ট্যুরিজম একটি বর্তমান বাস্তবতা। চিকিৎসা খরচ বাঁচাতে এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক রোগী বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশে উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে তখন অনেকেই দেশেই চিকিৎসা নেবে। তাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। আমরাও মেডিক্যাল সেক্টরে মেডিক্যাল ট্যুরিজম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারি। আমাদের দেশেও মেডিক্যাল ট্যুরিজমে বিনিয়োগ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। কারণ আমাদের দেশে কখনও জনবল সংকট হবে না। কেবল প্রয়োজন বিনিয়োগ এবং দক্ষ জনবল, যেটি জয়েন্ট ভেঞ্চারে খুবই সম্ভব এখানে।

স্বাস্থ্য খাতের সম্ভাবনাকে অনেকেই ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত। সঠিক পরিকল্পনা, যথাযথ পদক্ষেপ, সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগ এই খাতটিকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। তবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজন দক্ষ, সৎ, আন্তরিক ও উচ্চাভিলাষী জনবল ও সামাজিক শৃঙ্খলা। এই দুটি কাজ সময়সাপেক্ষ হলেও শুরু করতে হবে এবং সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, সুযোগের অভাবে আলোকিত হতে না পারার দলে অনেক দক্ষ এবং স্বচ্ছ উচ্চাভিলাষী লোক আছে যাদের খুঁজে বের করে দায়িত্বপূর্ণ জায়গায় বসাতে পারলে দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। আশা করতে দোষ কি?


ডা. মো. ছায়েদুল হক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন

এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক