শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ সচলতাই আশু প্রয়োজন

ড. মোহীত উল আলম
২২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ সচলতাই আশু প্রয়োজন

ফেসবুকে দেখেছি, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে দেয়ালের গায়ে নাকি লেখা আছে- একটি জাতিকে নষ্ট করতে চাইলে সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা নষ্ট করে দাও। আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ লেখক ফ্রেডারিক ডগলাস তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি যখন বালক ক্রীতদাস হিসেবে মি. অল্ড নামের একজন শ্বেতাঙ্গ লোকের বাসগৃহে থাকতেন, তখন তার প্রতি সদয় হয়ে মিসেস অল্ড তাকে কিছু পড়ালেখা শেখানোর দায়িত্ব নেন। একদিন আড়ি পেতে ডগলাস শুনতে পান, মি. অল্ড তার স্ত্রীকে শাসাচ্ছেন কেন তিনি দাস ছেলেটিকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, এর ফলে তো তার চোখ খুলে যাবে। মিসেস অল্ড স্বামীর কথায় বাধ্য হয়ে তাকে লেখাপড়া শেখানো বন্ধ করে দেন। এ সংলাপটি বালক ডগলাসের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং তিনি বুঝতে পারেন যে, লেখাপড়ার মূল্য জীবনে অতীব। আলোর পথের যাত্রী হতে গেলে লেখাপড়া শেখা ছাড়া উপায় নেই। এই গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি গোপনে নিজেই লেখাপড়া চালিয়ে গিয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। শেক্সপিয়ারের দ্য টেম্পেস্ট নাটকের ক্যালিবান চরিত্রটিও জীবনে লেখাপড়ার গুরুত্ব নিয়ে উল্টোভাবে দৃষ্টান্তযোগ্য। প্রসপেরোর মেয়ে মিরান্ডা ভৃত্য ক্যালিবানকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নেয়। কিন্তু ক্যালিবানের মধ্যে বিদ্রোহী সত্তা জাগরূক, তাই সে একদিন সরোষে প্রসপেরোকে বলে- তোমার ভাষা শিখে আমার এই লাভ হয়েছে যে, আমি তোমাকে তোমার ভাষায় গালি দিতে পারি। প্রসপেরোর সঙ্গে ক্যালিবানের সম্পর্কটা শুধু মনিব আর দাসের নয়, ঔপনিবেশিক আর উপনিবেশিত হওয়ার সম্পর্কও।

সাধারণ শিক্ষার এই আলোকে বাংলাদেশের হালচাল নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমে বর্তমানে নিয়োজিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা কাঠামো নিয়ে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করতে হয়। এটির নেতৃত্বে আছেন নোবেল বিজয়ী ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক পরিচিত এবং অত্যন্ত উদ্যমী ও পরম শিক্ষিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যার পরিচালনায় শিক্ষাই অগ্রাধিকার পাবে এটা বলা বাহুল্য। ড. ইউনূস দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। আরও সৌভাগ্যের কথা, এই যে শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যিনি যোগদান করেছেন তিনি সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে শিক্ষিত একজন অধ্যাপক, যার প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল কিংবদন্তিসম, জীবনে যিনি কখনো প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। সেই ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, যিনি আগে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, সেই তিনিই বাংলাদেশের বর্তমানে শিক্ষা উপদেষ্টা, যে নিয়োগটার ফলে আমি মনে করি জাতি ধন্য হয়েছে।

এ ছাড়া উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশ সদস্যই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত। আমি এই শিক্ষিত উপদেষ্টামণ্ডলীর সহযোগে পরিচালিত দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে দু-একটা মতামত দিতে চাই।

আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, যে শিক্ষা গ্রহণ করছে, মান অনুযায়ী সে শিক্ষিত হচ্ছে না। এবং অর্জিত মান ও প্রকৃত শিক্ষার মানের মধ্যে পার্থক্য দিন দিন আরও বেড়ে যাচ্ছে। একজন অষ্টম শ্রেণি পাস করা শিক্ষার্থীর মধ্যে যে রকমের শিক্ষা আশা করা যায়, তার মধ্যে তার প্রতিফলন নেই। একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী লোকের কাছে যে শিক্ষার মান আশা করা যায় তার মধ্যে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই। এই জায়গাটাতে আমরা পুরো জাতি ঠকে আছি।

আমার শিক্ষকজীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এই ধারণাও হয়েছে যে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শ্বেতহস্তী ছাড়া আর কিছু নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে কিন্তু শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে না। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠকে যাচ্ছে ব্যবসায়িকভাবে না হলেও গুণগতভাবে, কেননা এগুলোকে আপসমূলক ভর্তি করাতে হয় তাদের অর্থকোষ ঠিক রাখার জন্য।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বস্তরে উন্নতির জন্য প্রথমত শিক্ষার্থীর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে, শিক্ষার্থীর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে, আর শিক্ষকের গুণগত মান নিশ্চিত করতে চাইলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষার সমগ্র পরিবেশ উন্নতিকল্পে উপযোগী একটি শিক্ষানীতি অনুসরণ করার জন্য বর্তমানের উপদেষ্টাকে মনোযোগী হতে হবে। কাজটা অতীব দুরূহ ও দীর্ঘমেয়াদি।

প্রথমত শিক্ষার্থী। এটার মূল ধারণা হতে হবে যে, কোনো শিক্ষার্থীই গবেট নয়। তার বুদ্ধির উন্মিলন ঘটানোর জন্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োজিত। উজ্জীবিত শিক্ষা পাঠক্রম চালু থাকলেই শিক্ষার্থী সেটা গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে বিপরীত একটা কথাও মেনে নিতে হবে যে, প্রতিটা শিক্ষার্থীর চরিত্রে এমন একটা নিগূঢ় দিক থাকে, যেটি ব্যাখ্যার বাইরে, যেটিকে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শেষ পর্যন্ত বদলাতে পারে না। খারাপ খারাপই থেকে যায়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবনাদি ও পরিবেশ হতে হবে উন্মুক্ত ও প্রকৃতিসংশ্লিষ্ট। আমাদের চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল তেমন একটি আদর্শ স্কুলভবনের উদাহরণ হতে পারে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিশুশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিক্ষাদানে নিয়োজিত। এগুলো জাতীয় শিক্ষাস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।

শিক্ষাগ্রহণ করে মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য। এজন্য সুবিশাল গ্রন্থাগারের সংরক্ষণ প্রয়োজন। এখন অবশ্য ডিজিটাল প্রযুক্তি মানবসমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। তাই প্রতিটা স্কুলে প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থীর জন্য যেন অনলাইন প্রক্রিয়ায় জ্ঞানার্জনের সব সুযোগ খোলা থাকে, সেটি শিক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষাগ্রহণ ও প্রদানের সঙ্গে অর্থকরী বিষয়টা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একজন দিনে আনা দিনে খাওয়া শ্রমিকের সন্তান যেন লেখাপড়া করে সুশিক্ষিত হতে পারে তার ভার রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সরকারি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা এ ব্যাপারে অপরিসীম। এখানে ভালো স্কুলঘর, ভালো শিক্ষক ও ভালো শিক্ষার সরঞ্জামাদির আয়োজন রাখতে হবে। মাদ্রাসাগুলোর পরিবেশ অনেকাংশে আধুনিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য উপযোগী নয়। এদিকেও সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই একটি আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর ভৌত কাঠামো ও গুণগত বিচারে ভালো শিক্ষকের সমাবেশ করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীমাত্রই জ্ঞানার্জনের জন্য উন্মুখ থাকে।

সবচেয়ে বেশি বলতে হবে শিক্ষক সমাজের গুণগত মানের উন্নতির কথা। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় রকমের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রদানের সর্বোচ্চ উপায় মজুদ রাখতে হবে। এক রুমে দশজন শিক্ষক বসানোর চিন্তাটা বাদ দিয়ে প্রতি শিক্ষকই কী করে নিজস্ব অফিস, ডেস্কটপ ও অনলাইন সুবিধা পেয়ে শিক্ষা প্রদানে ব্রতী থেকে নিজেদের জ্ঞানবিজ্ঞানে বিকশিত করতে পারে সে রাস্তা তৈরি রাখতে হবে। এটা সত্য যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও সুবিধাদি হয়তো প্রতিযোগিতামূলক, কিন্তু তাদের সামাজিক অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে। কারণ অন্য চাকরিগুলোতে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে এটি অনুপস্থিত। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, যা শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অন্তরায়ের সৃষ্টি করে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিতমশাই’ গল্পের মতো শিক্ষকরা নিজেদের সাহেবের পোষা কুকুরের এক পায়ের সমান মনে করে।

দলীয় রাজনীতির প্রভাব বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি ক্যানসারসম মহামারীর সৃষ্টি করেছে। ফলে বুয়েটের মতো অতীব উঁচুমানের শিক্ষালয়ে আবরারের মতো মেধাবী ছাত্র খুন হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অবশ্যই রাজনীতি ও সমাজসচেতন হবে, কিন্তু সেটি যেন দলান্ধ দলকানায় রূপ না নেয়। জাতীয় পর্যায়ে অস্বাস্থ্যকর রাজনৈতিক চর্চাই আসলে এর জন্য দায়ী। দলীয় রাজনৈতিক শাসকমহলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হস্তক্ষেপ, রাজনীতিকরণ এবং পৃষ্ঠপোষকতা এগুলো যদি সমূলে উৎপাটন করা না যায়, অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি যদি আইন করে বন্ধ করে দেওয়া না হয়, তা হলে একদিন যখন দলীয় রাজনীতির আওতায় দেশ আবার ঢুকে যাবে, তখন আবারও ওই কলুষিত রাজনীতির শিকার হবে শিক্ষাঙ্গনগুলো, তখন যে লাউ সে কদুই হবে, এর বেশি কিছু নয়।

তাই শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে করজোড়ে মিনতি- তিনি যেন যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত বলবৎ করে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোকে রাহুমুক্ত করেন। আশা করি অন্যদের সঙ্গে তার মেধা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা প্রয়োগ করে তাতে তিনি সফলকাম হবেন।


ড. মোহীত উল আলম : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক