টাকা পাচার রোধ এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধি প্রসঙ্গে

মাহফুজুর রহমান
১৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
টাকা পাচার রোধ এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধি প্রসঙ্গে

বাংলাদেশে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম। বিগত কয়েক বছর ধরে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও আমলা এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা মিলে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এসব পাচারকারীর নাম জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরও তারা বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। নামে-বেনামে ব্যাংক থকে ঋণ নিয়ে সেসব টাকাও বিদেশে পাচার করে দিয়েছে ব্যবসায়ী নামধারী এসব লোক। বাংলাদেশে বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭ অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি বা নির্দেশনা ছাড়া বিদেশে টাকা পাঠালে বা বিদেশ থেকে আনয়নযোগ্য টাকা আনীত না হলে তাকেই টাকা পাচার বলে। বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুসারেও টাকা পাচার মানি লন্ডারিং অপরাধ এবং অজামিনযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য। এ অবস্থায় কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে এবং পাচারকারীরাও বিদেশে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রথমেই বলা যায় হুন্ডির কথা। আমরা জানি, প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশে থেকে অবর্ণনীয় কষ্টের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে দেশে পাঠান দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ আছে বলে। হুন্ডিতে টাকা পাঠালে দেশের যে ধরনের ক্ষতি হয় তা যদি এই রেমিট্যান্স আহরণকারী বন্ধুদের বোঝানো যায় তা হলে কখনই তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাবেন না। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে না; তার বদলে দেশে প্রবেশ করে মাদক আর অস্ত্র যা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর, জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং যুবসমাজের জন্য অতিশয় ক্ষতির কারণ। যারা হুন্ডি ব্যবসায়ে লিপ্ত আছে তারা বিদেশে কর্মরত বন্ধুদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং এর বিনিময়মূল্য হিসেবে বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের সঙ্গে পরিচালিত প্রেরকের হিসাবে বাংলাদেশি টাকা জমা করে দেয়; অথবা প্রেরকের পরিবারের কাছে নগদে পৌঁছে দেয়। এভাবে আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ পাচার হয়ে যায়।

অসাধু ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে সর্বাধিক পরিমাণে টাকা পাচার করেছেন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ ক্ষেত্রে আমদানিকারীরা আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে এবং রপ্তানিকারীরা রপ্তানিকৃত পণ্যের দাম কম দেখিয়ে টাকা পাচার করেন। একটি মেশিনের প্রকৃত মূল্য যদি ৫ লাখ ডলার হয় এবং সেটি আমদানি করার জন্য যদি ১০ লাখ ডলার মূল্যের ঋণপত্র খোলা হয় তা হলে মেশিনটি আনার বিপরীতে ৫ লাখ ডলার পাচার হয়ে যায়। বিপরীত দিকে রপ্তানির বেলায়ও উল্টোপথে একই ঘটনা ঘটে। একটি শার্টের দাম যদি ১০ ডলার হয় এবং এটির মূল্য ৫ ডলার দেখিয়ে যদি ঋণপত্র গ্রহণ করা হয় তা হলে প্রতিটি শার্ট রপ্তানির সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে ৫ ডলার পাচার হয়ে যায়। দেশে অবৈধভাবে টাকা উপার্জনকারীরা বিদেশে টাকা পাচারে আগ্রহী হয়ে থাকেন। কারণ বাংলাদেশের প্রতি তাদের কোনো মায়া ও দায়বদ্ধতা নেই। তারা বিদেশে টাকা পাচার করে কবে সেখানে গিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করবেন সে ভাবনাতেই মশগুল থাকেন। তখন তারা হুন্ডিওয়ালা ও অসাধু আমদানি এবং রপ্তানিকারকদের সাহায্য নিয়ে বিদেশে টাকা পাঠিয়ে থাকেন।

বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর ছাত্র-জনতার ঐক্য এবং দেশের প্রতি ভালোবাসার যে দৃশ্যমান উদ্যোগটি আমরা দেখতে পাচ্ছি তা কাজে লাগিয়ে এই মুহূর্তে টাকা পাচার বন্ধ করা এবং হুন্ডি প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা লক্ষ করেছি, কিছুদিন আগে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে আরও কমিয়ে দেওয়া হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। পরে পুলিশের কর্মবিরতিকালে এই দেশপ্রেমিক ছাত্রছাত্রীরা সুন্দরভাবে সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে। এবার যদি এই ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের উদ্যোগে এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় হুন্ডি প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রচার শুরু করে তা হলে হুন্ডি বন্ধ হবে এবং অন্তর্মুখী রেমিট্যান্সের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে দেশব্যাপী বিভিন্ন উপজেলার সমন্বয়কদের মাধ্যমে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের ঠিকানা সংগ্রহ, বিদেশের টেলিফোন নম্বর, মেইল এবং হোয়াটসঅ্যাপ ঠিকানা সংগ্রহ করতে হবে। হুন্ডিতে টাকা পাঠানো হলে কীভাবে দেশের ক্ষতি হয় তা উল্লেখ করে তাদের ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এজন্য তাদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা যেতে পারে, তথ্যসংবলিত প্রচারপত্র হোয়াটসঅ্যাপ বা মেইলে পাঠানো যেতে পারে। তা ছাড়া স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন গ্রামে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে প্রবাসী পরিবারের সদস্যদেরও বিষয়টি জানানো যেতে পারে, যাতে দেশ গড়ার কাজে তারাও অবদান রাখতে পারেন। অর্থনীতি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো মেইলে তাদের অবহিত করা যেতে পারে। বিনিয়োগের সুযোগগুলো তাদের জানানো যেতে পারে এবং বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এসব কাজ ছাত্রছাত্রীরা তাদের পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়েই করতে পারবে এবং তাদের পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না।

ছাত্রছাত্রীদের ভেতর থেকে যারা এ কাজটি সফলতার সঙ্গে করতে পারবেন তাদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে, প্রবাসীদের সঙ্গে ছোট ছোট সভা করে, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করার আয়োজন করা যেতে পারে। বিদেশে এসব সভায় যোগদানের ব্যয় বাংলাদেশ ব্যাংক বহন করতে পারে এবং বিদেশে সভার যাবতীয় আয়োজন ওইসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশি দূতাবাস সম্পন্ন করতে পারে। অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের আয়োজন অত্যন্ত সফল হয়েছিল।

বিভিন্ন এলাকায় কারা হুন্ডি ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত এ সংবাদ স্থানীয় লোকদের, বিশেষ করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ব্যাংকগুলোকে এ ক্ষেত্রে নির্দেশনা অনুসারে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিংয়ের কাজটি যথাযথভাবে করতে হবে। যারা হুন্ডির সঙ্গে জড়িত তারা দেশের শত্রু, অর্থনৈতিক উন্নয়নের শত্রু। এদের চিহ্নিত করতে হবে এবং বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। স্থানীয়ভাবে সবাই সচেতন হলে হুন্ডিওয়ালাদের ধরা অতি সহজ কাজ হয়ে দাঁড়াবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের শক্ত অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচারের কাজটি চিহ্নিত করা তুলনামূলকভাবে একটু কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিদেশে কর্মরত দূতাবাস যদি সেখানকার পণ্যমূল্য সম্পর্কে প্রয়োজনে একটি ধারণা প্রদান করতে পারে বা আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে তুলনা করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর হয়ে ওঠে তা হলে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের কাজটি প্রতিরোধ করা কঠিন হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক, আমদানি ও রপ্তানিকারীর ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মিলে যদি একটি ত্রিমুখী আয়োজন করে, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উন্নতমানের সফটওয়্যার ব্যবহার করে এবং বিদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আমদানিকৃত বা রপ্তানিকৃত পণ্যমূল্যের সঙ্গে তুলনা করে তা হলে এটি সহজেই ধরা যাবে বলে অনেকের বিশ্বাস। তবে এসব ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক এবং দুর্নীতিমুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা প্রয়োজন হবে।

বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের বোঝা নিয়ে বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে কখনই বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বা সুদ পরিশোধের বেলায় বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়নি। আমার বিশ্বাস, এবারও তা হবে না। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এবং বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই তারা পৌঁছে যাবেন সফলতার দ্বারপ্রান্তে। কারণ এখন দেশপ্রেমিক মানুষদের সহযোগিতার হাত থাকবে তাদের অনুকূলে। তা ছাড়া তাদের পাশে থাকছে অগণিত নিঃস্বার্থ এবং দেশপ্রেমিক ছাত্রসমাজ, যারা নিজ নিজ উদ্যোগে দেশের জন্য কাজ করে চলেছে। টাকা পাচার, হুন্ডি ইত্যাদি বন্ধ করতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি হবে একটি মাইলফলক। এযাবৎকালে বিশ্বের কোথাও ছাত্রদের আন্তরিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়নি, বাংলাদেশেও হবে না বলেই সবার ধারণা।


মাহফুজুর রহমান : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ডেপুটি হেড, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট