গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় ও চ্যালেঞ্জ
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের অনন্য অধ্যায় হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। গণ-অভ্যুত্থান থেকে আমরা পেয়েছি নতুন সরকার। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। গণ-অভ্যুত্থান থেকে এই সরকারের ভিত্তি, সেই চিন্তা থেকে গণ-অভ্যুত্থানের দর্শন জানা জরুরি। আমাদের জানা দরকার, গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় কী? এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল? আর সরকার কীভাবে সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে পারবে?
প্রথমেই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি জানা দরকার। সরল ভাষায় তা সবারই জানা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জনগণ শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত নতুন সমাজ নির্মাণের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। সেই অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয়। এ থেকে হতাশার জন্ম হয়। সেই হতাশার মাঝে আশা দেখেছিল এরশাদবিরোধী নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মধ্যে। এরশাদ সরকারের পতন থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আশা জাগে। এর পর কয়েক ধাপে সরকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু জনগণের সেই আকাক্সক্ষা আর স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। উন্নয়নের যাত্রা ধীরগতিতে চলছিল ঠিকই, কিন্তু দুর্নীতি, অবিচার, সন্ত্রাস, বৈষম্য, আর পরাধীনতার গ্লানি নিয়েই জনগণকে বসবাস করতে হয়েছে এতকাল। স্বাধীনতার গান আর স্লোগান মানুষের আর শুনতে ভালো লাগছিল না। এমন সময় একটি গান সবার মনে ধরে যায়। ‘ত্রিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাকে খুঁজছি’ শিল্পী হায়দায় হোসেনের কণ্ঠে ভেসে আসা সেই গান মানুষের মুখে মুখে। খুঁজতে খুঁজতে নতুন স্বপ্ন বুনে আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা।
বিশ্বজিৎ হত্যা আমাদের জানান দেয় ক্যাম্পাস কাদের হাতে; বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ড জানান দেয় কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া কুয়েটের এক হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক সেলিম হোসাইন স্যারের হার্ট অ্যাটাক আমাদের বুঝিয়ে দেয় সন্ত্রাসী ছাত্রদের হাতে শিক্ষকও অনিরাপদ। অথচ সেই অপরাধীদের শাস্তি দিতে বিচার বিভাগ ছিল নির্বিকার। তাই বলে মেধাবীদের মেধা তো আর নির্বিকার থাকতে পারে না। তারা লক্ষ করছে, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছান্ন। ঘুষ ছাড়া চাকরির চিন্তা করা ছিল দুষ্কর। বড় অঙ্কের ঘুষ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান কল্পনা করা যেত না। সরকারি চাকরির জন্য প্রশ্নফাঁস হতো যুগ যুগ ধরে; পিএসসি ছিল ঘুষের হাট। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যার ফলে কর্মসংস্থান মুখ থুবড়ে পড়ে। এমতাবস্থায় সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় মেধাবীদের হতাশা বেড়েই চলছে। অথচ ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দল কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কারণ তাদের রাজনীতি জনবান্ধব ছিল না।
সেই শূন্যতা পূরণে কেউ নেই, মুক্তির কথা বলারও যেন কেউ ছিল না। এমন সময়ে একগুচ্ছ মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীরা নেমে পড়ে ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনে। কোটা শব্দটা ছিল বৈষম্যের প্রতীক। সে কারণে ‘কোটা সংস্কার’ রূপ নিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। কোটা সংস্কারের দাবি মানার সংলাপ-পদ্ধতি পরিহার করা হয়। গ্রহণ করা হয় দমন পদ্ধতি। এর ফলে আন্দোলন ‘কোটা’ শব্দ থেকে বেরিয়ে আসে। পেটোয়া বাহিনী দিয়ে হামলার প্রতিবাদে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আন্দোলন দমনে পুলিশ গুলি আর মারণাস্ত্র ব্যবহার করে।
লংমার্চের ঘোষণায় পুরো দেশের লাখ লাখ মানুষ ঢাকার পথে চলে আসে। ৫ আগস্ট আমরা দেখলাম ছাত্র-জনতার সচিত্র গণ-অভ্যুত্থান। আর্মি-পুলিশের সব গুলি থমকে যায়। সরকার পদত্যাগ করে। গঠিত হয় নতুন সরকার।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে সতেরো ‘উপদেষ্টার’ সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়। এই নতুন সরকারের ভিত্তি গণ-অভ্যুত্থান। গণ-অভ্যুত্থানের আলোকেই এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালিত করছে। সরকারকে তাই বুঝতে হবে, গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় কী ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় হলো জনগণের সাধারণ ইচ্ছা পূরণ করা। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাই নতুন সরকারের জন্ম দিয়েছে। আর তাই সরকারকে বুঝতে হবে জনগণের ভাষা। জনগণের এই সার্বভৌম শক্তির নেতৃত্বে ছিল একঝাঁক সমন্বয়ক। তারা মেধাবী ছাত্রছাত্রী। তারাই প্রকাশ করছে জনগণের চাওয়া-পাওয়া। তাদের প্রকাশে স্পষ্ট যে কোনো প্রকার বৈষম্য, শোষণ, দলীয়করণ, ঘুষের প্রবাহ, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অবিচার এমনকি বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ এ দেশের জনগণ মেনে নেবে না। মূলত শোষণ-বঞ্চনা আর ফ্যাসিবাদী শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল এই গণঅভ্যুত্থান। এই গণ-অভ্যুত্থানের বিশেষত্ব হলো এই অভ্যুত্থান কতগুলো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রচিত হয়নি। এর নেতৃত্বে ছিল নির্দলীয় ছাত্রসমাজ। তাদের রচিত গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায় ছিল এমন সরকার ও শাসনব্যবস্থা জারি করা যা দেখে জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করবে, আর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সে ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করে গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায় পূরণ করা সম্ভব হবে না।
যে কোনো গণঅভ্যুত্থানের মতো ছাত্র-জনতার এই গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিবিপ্লব। প্রতিবিপ্লব মানে গণঅভ্যুত্থানের সরকার হঠানো এবং সেজন্য বিভিন্ন দিক থেকে পদক্ষেপ নেওয়া। দুই দিক থেকে এমন প্রতিবিপ্লব হতে পারে। সাধারণ চিত্রে বোঝা যায়, ছয় ধরনের ছক রয়েছে প্রতিবিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য।
এক. সরকার পদত্যাগের পরপরই গোপনে পুলিশ হত্যা করে পুলিশদের কর্মবিরতিতে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং পুলিশ বাহিনীকে নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা।
দুই. সরকার পদত্যাগের রাতে ভাস্কর্য ভাঙচুর, হিন্দুদের বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেওয়া, বিভিন্ন নেতাদের বাড়ি ও স্থাপনায় হামলা এবং মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীকে জরুরি অবস্থা জারির দিকে নিয়ে যাওয়া।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
তিন. জরুরি অবস্থা জারি করাতে পারেনি বলে দুরভিসন্ধিমূলক অস্ত্রধারী একদলকে সংঘবদ্ধভাবে মধ্যরাতে ডাকাতিতে নামিয়ে দেওয়া। সবার মধ্যে আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়া। যেন মানুষ গণঅভ্যুত্থানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে।
চার. জাতীয় সরকার গঠনে এমন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করা যেন স্বৈরাচারী কাঠামো ও কর্তৃত্ববাদী শাসন অক্ষত রাখা যায়। বিদেশি শক্তি এটাই চায়।
পাঁচ. আন্দোলনের পক্ষশক্তি আর বিপক্ষ শক্তির মধ্যে বিভাজন ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা। বিরোধীদের চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করা। এটা আত্মঘাতী। কোথাও সহিংসতা বা নৈরাজ্য হলেই এর কারণ না বুঝেই ‘এবার বুঝুক স্বাধীনতা’ এই বয়ান প্রচার করা। এর মানে জনগণের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা।
ছয়. সরকার দ্বারা পরিচালিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা যদি দুর্নীতি আর বৈষম্যের নীতি অল্প বিস্তর গ্রহণ করে সেই ব্যবস্থাও ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে পারে। এতে প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি থাকে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
এসব ক্ষেত্রে সতর্কতা অত্যাবশ্যক। দেশি-বিদেশি শক্তির চক্রান্ত প্রতিহত করতে প্রশাসনিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন দরকার। সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ন্যায় ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সাজানো অতীব জরুরি। শুধু তাই নয়, সরকার পরিচালনার জন্য নতুন গঠনকাঠামো অবশ্যই তৈরি করতে হবে। যে কাঠামোতে দুর্নীতি, অবিচার আর বৈষম্যের কোনো সূত্র থাকবে না। গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় হলো, জনগণের জন্য এমন গঠনকাঠামো হাজির করা যার আলোকে সব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে। যেন শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানচর্চা, গবেষণা আর চরিত্র গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। সেই গঠনকাঠামো যেন আমলাতন্ত্রকে সীমিত ক্ষমতা প্রদান করে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতার সংস্কৃতি যেন প্রতিষ্ঠা পায়। সরকার নিজেই যেন দমনমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করতে না পারে, সেদিক বিবেচনায় মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রয়োজন। আমরা চাই সৎ ও যোগ্যদের ক্ষমতায়ন। আমরা চাই জনগণের মধ্যে সার্বিক ঐক্য। এটাই গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়।
ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়