স্বৈরশাসনের কালে সাংবাদিকতা
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীন সাংবাদিকতা। শব্দগুলো অনেক দিন তেমন আর শোনা যায়নি। তার মানে কি এই যে, আমাদের মন থেকে এই শব্দগুলো হারিয়ে গেছে? আমরা যারা সাংবাদিকতায় জড়িত, আমরা জানি, এসব শব্দ হারায়নি আমাদের মন থেকে। বরং গত ১৫/১৬ বছরে বারবার মনে পড়েছে, মনকে ভীষণভাবে বিদ্ধ করেছে। আমরা সংবাদকক্ষে প্রায় প্রতিদিন এর মুখোমুখি হয়েছি। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে বলত, এদেশের সাংবাদিকরা সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং এখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিশে^র মধ্যে অনন্য। আমরা শুনতাম এবং বোবা হয়ে থাকতাম। আমরা বলতে পারতাম না যে একথা সর্বৈব মিথ্যা। কিন্তু কেন আমরা কথা বলতে পারতাম না মিথ্যার বিরুদ্ধে? ভয়ে, আতঙ্কে। ন্যায় ও সত্য কথা বলতে পারছি না ভয়ে, আতঙ্কেÑ সেটাও সরাসরি বলা যেত না। তবে একেবারেই নির্বাক আমরা থাকিনি। সরাসরি বলতে না পারলেও প্রকারান্তরে সত্যটা তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছি বারবার। যেমন দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত এই লেখাটি
আপনি চুপ করে আছেন। আপনি চুপ করেই আছেন। আপনার চারপাশে সবাই কি চুপ করে আছে? আপনার পায়ের কাছে নদী। তার বুকে স্রোত। আপনি কবি নন। কবি হলে বলতেন, কল্লোলিনী, স্রোতস্বিনী। নদী চুপ করে নেই। সে কথা বলে। আপনি তার কথা বুঝতে পারতেন কবি হলেÑ ‘রাইসর্ষের ক্ষেত সকালে উজ্জ্বল হলো দুপুরে বিবর্ণ হ’য়ে গেল/তারি পাশে নদী,/নদী, তুমি কোন কথা কও?/অশথের ডালপালা তোমার বুকের ’পরে পড়েছে যে,/জামের ছায়ায় তুমি নীল হ’লে,/আরো দূরে চলে যাই/সেই শব্দ সেই শব্দ পিছে পিছে আসে;/নদী না কি?/নদী, তুমি কোন কথা কও?’ আপনি শুনছেন, অথবা শুনছেন না। আপনি দেখছেন, অথবা দেখছেন না। আপনি চুপ করে আছেন। আপনি চুপ করেই আছেন। আপনার চারপাশে সবাই কি চুপ করে আছে? আপনার পাশেই বৃক্ষ। ডালপালা ছড়িয়ে সবুজ পাতার দোলায় বাতাসের পরশ। সেও কথা বলে ‘গাছ হলো ক্ষমাশীল আর যত্নশীল। সে ঘুমায় না, স্বপ্নও দেখে না, তবে সে স্বপ্নদর্শীর নিগূঢ়তা গচ্ছিত রাখে, দিবারাত্রি দাঁড়িয়ে থাকে পাহারা দেয়, পথিক আর আকাশকে শ্রদ্ধা জানায়।’ আপনি গাছ নন। গাছের ভাষায় আপনি কথা বলেন না। আপনার চারপাশে সবাই কি কথা বলে না? আপনার পায়ের কাছে শিশির। আপনার পায়ের কাছে ঘাস। আপনার সামনে বাড়ি, শালিক পাখি। তারা কথা বলে ‘উঠানের পায়রা শালিক কাক উড়ে-উড়ে বলে:/‘এত দিন নক্ষত্রের তলে/রৌদ্রের আকাশে/তোমরা তো ছিলে এই খোড়ো-ঘরে আমাদের পাশে/তোমরা কোথায় যাও আজ, আহা, এই মাঠ ঘাস ছেড়ে’/বাতাবির ডালে ব’সে ঘাড় নেড়ে নেড়ে/বলে তারা এইসব কথা...।’ কথা বলে আকাশের নীল, মেঘের সাদা-কালো, বাতাসের সমীরণ; কথা বলে সন্ধ্যার ছায়া, রাতের নির্জনতা, ভোরের কুসুমকলি; কথা বলে বেড়ালের চকিত মুহূর্ত, কুকুরের বঙ্কিম সড়ক, খাঁখাঁ দুপুরের ডাক। কথা বলে নাগরিক ও অ-নাগরিক জীবন; কথা বলে বই, খবরের কাগজ। আপনার চারপাশে কথা বলে সবকিছু। তারা কথা বলে আপন মহিমায়। তাদের কথা বলার স্বাধীনতা আছে। আপনি চুপ করে আছেন। আপনি শুনছেন, অথবা শুনছেন না। আপনি দেখছেন, অথবা দেখছেন না। আপনি চুপ করেই আছেন। আপনি মূক ও বধির নন। আপনি দৃষ্টিহীন নন। আপনি চুপ থেকে আকাশের বাক-স্বাধীনতা হরণ করতে পারবেন? আপনি চুপ থেকে বাতাসের বাক-স্বাধীনতা হরণ করতে পারবেন? আপনি চুপ থেকে আগুনের বাক-স্বাধীনতা হরণ করতে পারবেন? আপনি চুপ থেকে চাঁদের বাক-স্বাধীনতা হরণ করতে পারবেন? শিশিরের ভাষা, ঘাসের ভাষা, শালিকের ভাষা, সন্ধ্যার ছায়ার ভাষা, রাতের নির্জনতার ভাষা, ভোরের কুসুমকলির ভাষা, চকিত মুহূর্তের ভাষা আপনার নয়। তবে কি আপনি নির্বাক সম্প্রদায়ভুক্ত, বাকশক্তিহীন? আপনার জিভ কেটে ফেলা হয়নি, আপনার চোখ উপড়ে ফেলা হয়নি, আপনার কানে সিসা ঢেলে দেয়া হয়নি। আপনি দেখতে পান। আপনি শুনতে পান। আপনি কথা বলতে পারেন। কিন্তু আপনি চুপ করে আছেন। আপনি চুপ করেই আছেন। কেন? মুক্তচিন্তায় দিনের আলো কথা বলে মুক্তকণ্ঠে, সে নির্ভীক। মুক্তচিন্তায় নদী কথা বলে মুক্তকণ্ঠে, সে নির্ভীক। মুক্তচিন্তায় চাঁদ কথা বলে মুক্তকণ্ঠে, সে নির্ভীক। মুক্তচিন্তায় দোয়েল কথা বলে মুক্তকণ্ঠে, সে নির্ভীক। কিন্তু, আপনি মানুষ, আপনি কথা বলতে পারেন না ভয়ে, আতঙ্কে। [৮.৯.২০২৩/ দিনযাপনের কড়চা/ভয়ে, আতঙ্কে]
যেমন দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত এই লেখাটি-
আপনার কি কোনও বিষয়ে মত আছে? মানে, নিজস্ব মতামত আরকি। আপনি যদি এ দেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে দেশের আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যাপারে আপনার মত থাকা স্বাভাবিক। আপনার মত থাকবে, মত প্রকাশও করতে পারবেনÑ এটা আপনার নাগরিক অধিকার। তো, আপনার কি নাগরিক অধিকার আছে? নিশ্চয় আছে।
আপনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন, মানে এ দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক, তাহলে গণতান্ত্রিক পন্থায় ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে নিতে পারবেন। এও আপনার নাগরিক অধিকার এবং এটাই স্বাভাবিক। তো, সবশেষ কবে এই অধিকার প্রয়োগ করেছেন? করেছেন তো অবশ্যই।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শিবঠাকুরের গল্পটা আপনার হয়তো জানা আছে। গল্পটা লিখেছিলেন সুকুমার রায়। সুকুমার রায় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র, সত্যজিৎ রায়ের পিতা, সন্দীপ রায়ের পিতামহ। চার পুরুষ ধরে সব বিখ্যাত বিখ্যাত নাম। এমন দেখা যায় না সচরাচর। যাই হোক, গল্পটায় আসা যাক।
শিবঠাকুরের একটা ‘আপন দেশ’ আছে। সেখানে, সুকুমার রায় ছড়া কেটে লিখেছেন-
শিবঠাকুরের আপন দেশে
আইন-কানুন সর্বনেশে!
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দারুণ ইন্টারেস্টিং একটা গল্প। সেই দেশে ‘কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে/প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,’ তারপর ‘কাজির কাছে হয় বিচারÑ/একুশ টাকা দণ্ড তার।’ ‘সেথায় সন্ধ্যে ছটার আগে/হাঁচতে হলে টিকিট লাগে/হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে/দম্দমাদম্ লাগায় পিঠে,/কোটাল এসে নস্যি ঝাড়েÑ/একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।’ বুঝতেই পারছেন, ‘আপন দেশে’ শিবঠাকুর কী চিজ আর কী দুর্দান্ত তার আইন-কানুন। এর পর সুকুমার বর্ণনা করেছেনÑ ‘কারুর যদি দাঁতটি নড়ে./চারটি টাকা মাশুল ধরে,/কারুর যদি গোঁফ গজায়./একশো আনা ট্যাক্সো চায়Ñ/খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,/সেলাম ঠোকায় একুশ বার।’ দৃশ্যটা কল্পনা করুন একবার। আপনি পিছলে পড়বেন, সন্ধ্যা ছয়টা বাজার আগে টিকেট না কেটে হাঁচি দেবেন, আপনার দাঁত নড়বে, গোঁফ গজাবে আর শিবঠাকুরের পেয়াদা কিছুই বলবে না তাতো হয় না। সেখানে তো আইন-কানুন আছে। তারপরÑ ‘চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়/এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়,/রাজার কাছে খবর ছোটে,/পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,/দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়Ñ/একুশ হাতা জল গেলায়।’ ঠিকই তো, চলবেন চলুন, কিন্তু ইতিউতি তাকাবেন কেন! একুশ হাতা পানি তো খেতেই হবে, ভাই! আর, কবিতা লিখবেন? জেনে রাখুনÑ ‘যে সব লোকে পদ্য লেখে,/তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,/কানের কাছে নানান সুরে/নামতা শোনায় একশো উড়ে,/সামনে রেখে মুদীর খাতা-/হিসেব কষায় একুশ পাতা।’ উড়ে মানে বুঝেছেন? উড়ে মানে উড়িষ্যার লোক, এদের ব্যঙ্গ করে ‘উড়ে’ বলে সম্ভাষণ করত কোলকাতার বাবুরা। এবংÑ ‘হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে/নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,/অম্নি তেড়ে মাথায় ঘষে,/গোবর গুলে বেলের কষে,/একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকেÑ/একুশ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে।’
আপনি কি শিবঠাকুরের দেশে বাস করেন? না, মোটেই না। অনেক প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া যে দেশ, সেটা কি শিবঠাকুরের ‘আপন’ দেশ হতে পারে? সুতরাং একুশ টাকা দণ্ড দেবেন কেন, একুশ দফা হেঁচে মরবেন কেন, একুশ বার সেলাম ঠুকবেন কেন, একুশ হাতা জল গিলবেন কেন, একুশ পাতা হিসাব কষবেন কেন এবং একুশ ঘণ্টা ঝুলে থাকবেন কেনÑ আপনাকে ভাবতে হবে। এসব কিছু ঘটছে নাকি? না, মোটেই না। আমি শুধু আপনাকে ভাবতে বলছি।
আপনার কি মনে আছে আমির আজিজের কথা? সেই যে ভারতের এক তরুণ একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘সব ইয়াদ রাখা জায়েগা’ শিরোনামে। সেই কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে আবৃত্তি করেছিলেন পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্যান্ডের রজার ওয়াটার্স। ‘সব মনে রাখা হবে/সবকিছু মনে রাখা হবে’Ñ লিখেছিলেন আমির আজিজ। বাঙালি ভুলোমনের জাত, বদনাম আছে। আপনি কি মনে রাখবেন? [২৬.২.২০২৩/দিনযাপনের কড়চা/আমি শুধু আপনাকে ভাবতে বলছি]
প্রতিদিনের সংবাদের ভিতর দিয়ে আমাদের বলতে হতো, সব ঠিক আছে; কিন্তু আমরা জানতাম, কিছু ঠিক নেই। সংবাদের ভিতর দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর বিপুল সফলতা দেখাতে হতো; গণতন্ত্রহীনতা, বীভৎসতা আর বর্বরতার চিত্রগুলো আড়াল করতে হতো। আমাদের কোনও উপায় ছিল না। তারা মুখে বলত বটে, এদেশে সাংবাদিকরা স্বাধীন, কিন্তু আমরা জানতাম আমাদের হাত-পা বাঁধা। হয় চাটুকারিতা, নয় মুখ বন্ধ রাখা- এটাই ছিল আমাদের জন্য স্বৈরশাসকদের দুর্লঙ্ঘনীয় অলিখিত বিধান।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
আমাদের কি তাহলে সাহস ছিল না? আমাদের হাত-পা কি তাহলে সিঁটিয়ে গিয়েছিল? না। স্বৈরতন্ত্রের দুর্বিষহ দিনগুলোর মধ্যেও আমরা কাজ চালিয়ে গেছি নৈতিক অবস্থান ধরে রেখেই। শুধু সাংবাদিকরাই নন, সংবাদপত্রে জড়িত থাকেন মুদ্রণ, বাঁধাই, হিসাবরক্ষণ, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি নানা বিভাগের প্রচুরসংখ্যক কর্মী। সংবাদপত্র অফিসে তালা ঝোলার অর্থ- এই কর্মীদের বেকার হয়ে পড়া। তাদের আয়ের ওপর অনেক পরিবার নির্ভরশীল। সুতরাং আমাদের সাবধান হতে হয়েছিল, ওই পরিবারগুলোর কথা ভাবতে হয়েছিল। নীরবতাও এক ধরনের প্রতিবাদ। আমরা স্বৈরতান্ত্রিক কুশাসনের বিরুদ্ধে অনেক সময় নীরবতারূপ প্রতিবাদ করেছি। কখনও সাহস হারাইনি।
আমাদের সামনে আজ আবার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গণতান্ত্রিকতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মুক্ত-সাংবাদিকতার রুদ্ধ দুয়ারগুলো খুলে দিতে হবে। নির্যাতনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। দৈনিক আমাদের সময় সর্বদাই গণমুখী সংবাদপত্র। আমাদের সময় দেশবাসীর সঙ্গে ছিল, দেশবাসীর সঙ্গেই রয়েছে এবং দেশবাসীর সঙ্গেই থাকবে। এটাই আমাদের সময়-এর নৈতিক অবস্থান এবং এটাই দৈনিক আমাদের সময়-এর চালিকাশক্তি। স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটাতে যে ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থীসহ যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, যেসব নিষ্পাপ শিশু অকালে মৃত্যুবরণ করেছে, যাদের আন্দোলনে আজ আমরা মুক্তির আলোকবর্তিকা হাতে পেয়েছি- প্রত্যেকের কাছে আমরা চিরঋণী।
প্রমিত হোসেন : সাহিত্যিক। ফিকশন, নন-ফিকশন বইয়ের অনুবাদক। দৈনিক আমাদের সময়ের সহযোগী সম্পাদক