বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা করণীয়

ড. শফিকুল ইসলাম
০৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা করণীয়

বর্তমানে দেশে এখনো সংকট চলছে। কারণ আমাদের সংখ্যালঘু ভাইবোনদের বাড়িতে আঘাত ও নির্যাতন করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশা করি না। এই অবস্থা থেকে দ্রুত আমাদের স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল হলো। তবে মানুষ সত্যিকার অর্থে যে বাংলাদেশ চায়, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হলে সাধারণ জনগণের কোনো লাভ হবে না। বরং গ্রামের কথায় ‘যে লাউ সেই কদু’ কথা সত্য হবে। তাই ছাত্র-জনতাকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো গণতন্ত্র ও সুশাসন। যদি নতুন সরকার বা প্রশাসন এটা নিশ্চিত না করতে পারে, তা হলে বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। কারণ স্বাধীনতার পর থেকেই কোনো সরকার সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

সরকার বা প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা, নৈতিকতা, জবাবদিহি ও জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে যদি রাষ্ট্রীয় শাসনকাজ পরিচালনা করা যায় তা হলে মানুষের স্বস্তি ফিরে আসবে। বাংলাদেশের শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনীতিতে গত ৫৩ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে সুশাসন, জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রের সংকট আমাদের মধ্যে বিরাজমান। নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের এখানে যথেষ্ট কাজ করার সুযোগ রয়েছে। নতুন প্রজন্মের ইচ্ছা পূরণ করতে হলে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। যেখানে ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় বলা যাবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসন রক্ষায় তারাই ভরসা। গণতন্ত্র মানে যেখানে নির্বাচনে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, হামলা-প্রতিহামলা, ভাঙচুর-নৃশংসতা, হানাহানি, খুনাখুনির মতো হেন খারাপ দৃষ্টান্ত থাকবে না। ধারালো অস্ত্রের আস্ফালন আর বোমাবাজি বন্ধ করতে হবে।

ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী নির্বাচন, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও নাগরিক অধিকার পর্যালোচনাপূর্বক বিশ্বের গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে রয়েছে নরওয়ে, আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে এসব দেশের মতো শাসনব্যবস্থা থাকবে।

তবে এর জন্য দরকার মানসম্পন্ন শিক্ষা। যা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ঘটাতে পারবে। ভবিষ্যৎ ভরসার আশা-ভরসা নতুন প্রজন্ম। এই প্রজন্মের মেধা কাজে লাগানোর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। শিক্ষার প্রতি দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। তবে তর্ক রয়েছে বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্য গুণগত উন্নয়নের চেয়ে পরিমাণগত উন্নতি বেশি দেখা যায় বলে মতামত দেন বিশ্লেষকরা। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন দরকার।

বরাবরের মতো আন্দোলন মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। শিক্ষার মধ্য দিয়ে সহিষ্ণুতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, মুক্তচিন্তার বিস্তার ঘটাতে হবে। আগামী প্রজন্মের জন্য গুণগত এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষা অপরিহার্য। তবে এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে যেমনÑ ক. সাম্প্রতিক সময়ে হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। খ. ঘটনাগুলোর দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য তদন্ত করতে হবে, যে তদন্তের আলোকে অপরাধীকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। গ. শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের মৌলিক ভূমিকা রাখতে হবে এবং তাদের চিন্তা-আবেগকে গুরুত্ব দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের ওপর জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ঘ. বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী বর্তমান প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং বিতর্কিত লোকদের প্রশাসন থেকে অপসারণ করতে হবে। ঙ. বিশেষ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যে পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে নিহত হয়েছে, তাকে চাকরি থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে। চ. বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসদাচরণ এবং একই সঙ্গে এসব ঘটনার তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোটা আন্দোলন ঘিরে নিহতদের জন্য শোক দিবস চালু করা যেতে পারে। ছ. একই সঙ্গে শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সব নাগরিকের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জ. আহত সবার চিকিৎসা এবং নিহত সবার পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। যদিও জীবনের মূল্য কোনো কিছু দিয়েই পূরণ করা যায় না। ঝ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ রাখতে হবে। তবে ছাত্র সংসদ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকতে হবে, যার মাধ্যমে নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে। কিন্তু কেন জানি আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আগ্রহ দেখাই না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এ বিষয়ে তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। অথচ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন আর নিয়মিত হচ্ছে না। অনেকের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে ভয় পায়। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কথা নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ থাকা বাধ্যতামূলক এবং সময়মতো নির্বাচন হওয়া জরুরি। কারণ ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে। এর জন্য দরকার ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ঞ. সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা যেতে পারে। কারণ তারা কেউ আবেগের বশবর্তী বা কারও উসকানিতে অন্যায় কাজ করতে পারে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হযেছিল। বন্ধ না রেখে কোনো উপায় ছিল না। কারণ আন্দোলন এখান থেকে শুরু। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রমও স্থগিত। এই সংকটে কর্তৃপক্ষকে সঠিক বা বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া খুব কঠিন। আন্দোলনের ধাক্কা লেগেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। ২০২৪ সালে যাদের পড়াশোনা সম্পন্ন হওয়ার কথা, তাদের যথাসময়ে ডিগ্রি ও সনদপত্র দেওয়ার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

করোনা মহামারীর মতো আরেকটা ধাক্কা খেতে যাচ্ছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। দ্রুত শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসুক। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই এই মুহূর্তে বর্তমান চলমান সেমিস্টার চার মাসে করা যেতে পারে। চলমান সংকটে অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক ক্ষতি হয়েছে, তাদের মানসিক ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য এবং কারও উসকানিতে মনোযোগ দেওয়ার সময়ও কম পাবে। দেশের সব প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে, যাতে তারা সঠিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যায়। দেশের এই সংকট মুহূর্তে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়িত্ব রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব মহল ধৈর্য, সহনশীলতা, বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতে যেন এমন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেষ্ট এবং সতর্ক থাকতে হবে।


ড. শফিকুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ