উন্নয়নকে স্তব্ধ করতেই পরিকল্পিত সন্ত্রাস

তাপস হালদার
৩১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
উন্নয়নকে স্তব্ধ করতেই পরিকল্পিত সন্ত্রাস

শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনকে পুঁজি করে বিএনপি ও জামায়াতের দুষ্কৃতকারীরা ঢাকা শহরে নজিরবিহীন তা-ব চালিয়েছে। এই তা-বকে একাত্তর সালের নৃশংসতার সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় তা-ব চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। যাত্রাবাড়ীতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তা-ব। তার পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোল প্লাজা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজধানীবাসীর গর্বের মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন দুটো সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুন যাতে নেভাতে না পারে এজন্য টার্গেট করে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশনগুলোতে আগুন দেওয়া হয়। দুষ্কৃতকারীদের হামলায় অনেক ফায়ার ফাইটাররাও আহত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সেতুভবন, বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে তা-ব চালানো হয়। বিআরটিএর ডেটা সেন্টারে আগুন দেওয়ার কারণে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এভাবে টার্গেট করে কখনো সরকারি স্থাপনায় হামলা করা হয়নি। দুষ্কৃতকারীরা শুধু রাজধানীই নয়, ঢাকাকে অচল করে দিতে আশপাশের জেলাগুলোতেও একইভাবে হামলা চালায়। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোতেও একই কায়দায় হামলা করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি স্থাপনাগুলোতে টার্গেট করা হয়েছে।

ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে প্রবেশপথগুলোকে টার্গেট করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-আরিচা সড়কের সাভার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের উত্তরার প্রবেশপথগুলো অচল করে দেয়।

দুষ্কৃতকারীরা পুলিশ সদস্যদের টার্গেট করে মেরেছে। অনেকে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে, আবার অনেকে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্সও। র‌্যাব সদস্যকে হত্যা করা, পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা, অবরুদ্ধ করা, পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ভাঙতেই এসব করা হয়েছে।

কারাগারে আগুন দিয়ে আসামিদের ছিনতাই করার ইতিহাস অতীতে কখনো ঘটেনি। নরসিংদী জেলা কারাগারে আগুন দেওয়া হয়। হামলা চালিয়ে দুই নারী জঙ্গিসহ মোট নয় জঙ্গি এবং আট শতাধিক বন্দিকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ সময় দুষ্কৃতকারীরা ৮৫টি অস্ত্র ও আট হাজারের বেশি গুলি নিয়ে পালিয়ে যায়। উদ্দেশ্যে ছিল এসব জঙ্গি ও দাগি আসামিরা বের হয়ে ওদের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে শামিল হবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন অর্থাৎ বিটিভি হলো একটি রাষ্ট্রের প্রধান গণমাধ্যম। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটিই ছিল বাংলা ভাষার প্রথম টিভি চ্যানেল। একাত্তর সালে পাক হানাদার বাহিনীও বিটিভিতে হামলা করেনি, কিন্তু এরা শুধু সেখানে হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আর্কাইভ থেকে নষ্ট হয়ে গেছে।

দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর চাউর করা হয়েছে। আবার কখনো বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তিনি গণভবনে নেই। এসব গুজব আন্দোলনকে বেগমান করতে সুকৌশলে প্রচার করা হয়েছে। ঢাকার সবচেয়ে সংঘর্ষপ্রবণ এলাকা রামপুরা, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ীতে হামলার সময় মসজিদের মাইক ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের সহায়তা করতে এলাকাবাসীকে এগিয়ে আসতে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। সারাদেশ থেকে শিবির ক্যাডারদের ঢাকায় নাশকতার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। শিবির ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ঢুকে পড়ে আন্দোলনের নামে নাশকতা চালিয়েছে। পরিকল্পনামাফিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় তা-ব চালিয়েছে। কোটা আন্দোলন শুরুর দিকে অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ ছিল। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সঙ্গতি জানিয়ে সরকার আপিল করেছিল। তখন তাদের মধ্যে সরকারবিরোধিতা ছিল না। তাদের আন্দোলন ছিল সরকারকে চাপে রাখার কৌশল। কিন্তু আন্দোলনটা যখন দীর্ঘায়িত হচ্ছিল তখন এর মধ্যে ষড়যন্ত্রকারী ঢুকে পড়ে। সেটা ঢোকাটাও স্বাভাবিক, ষড়যন্ত্রকারী তো বসে থাকবে না। কিন্তু প্রশাসন তখন মনে করেছিল শিক্ষার্থীরাও সংস্কার চাচ্ছে, সরকারও সংস্কার চাচ্ছে তাহলে তো সমস্যা নেই। সেজন্যই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নীরব সমর্থন জানানো হয়েছিল। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে বিএনপি-জামায়াত।

প্রধানমন্ত্রী কখনো আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেননি। তিনি একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের চাকরি হবে নাকি রাজাকারের নাতিপুতিদের চাকরি হবে? কথাটা তো শতভাগ সত্য। একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতি ও একজন রাজাকারের নাতির যদি সমযোগ্যতা থাকে তা হলে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধার নাতিই চাকরি পাবে এটাই বলেছেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিকৃত করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচার করা হলো, প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলেছে। রাতের মধ্যে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজাকার রাজাকার স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল। তার পর তো সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। এটি ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রশিবির ঢুকে গিয়ে আন্দোলনকারীদের ব্যানারে ভয়াবহ তা-ব শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা একটি জাতির জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্তে অঙ্কিত হয়েছে বাংলাদেশ। বাহান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করেছে। এমন অর্জন বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজাকার দাবি করে স্লোগান দেওয়া জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা দেয়।

দেশের মানুষের দিকে তাকিয়ে কারফিউর মধ্যে সুপ্রিমকোর্ট বসে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ জাতির সংকট নিরসনে এগিয়ে এসে ঐতিহাসিক রায় দেয়। কোর্টের সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে দ্রুততম সময়ে রায় প্রয়োগ করে আপিল বিভাগ। সরকারও রায়ের আলোকে ৯৩ শতাংশ সাধারণ রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা হয়। বিএনপিসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সব আন্দোলনেই সরকার পতনের স্বপ্ন দেখে। এবারও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখেছিল।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল হয়েছে। যা চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি পেয়েছে। এখন তাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সময়, সরকারকেও দ্রুত সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। এটা তিনি না বললেও করবেন। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। এখন যেসব শিক্ষার্থী জেলে কিংবা মামলার ভয়ে পালিয়ে আছে তাদের সাধারণ ক্ষমা করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এখনো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন করে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে, এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকলে মূল দুষ্কৃতকারীই আড়াল হয়ে যাবে। এসব ধ্বংসযজ্ঞ সাধারণ ছাত্ররা করেনি, তারা যেমন বলেছে, জনগণও সেটাই বিশ্বাস করে।

নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজে বের করতে হবে, অর্থদাতাদের অর্থের উৎস বন্ধ করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের মূলোৎপাটন করতে পারলেই শান্তি আসবে।


তাপস হালদার : সাবেক ছাত্রনেতা ও কলাম লেখক