দুঃখজনক, অনাকাক্সিক্ষত, দুর্ভাগ্যজনক
ক্ষুব্ধ তারুণ্যের একটা দারুণ শক্তি আছে। সে শক্তির আলাদা একটা সৌন্দর্যও আছে। ’৫২, ’৬৯, ’৭১-এ আমরা তারুণ্যের শক্তির সে সৌন্দর্য দেখেছি। স্বাধীন বাংলাদেশেও সব সময় সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে ছাত্রসমাজ। ’৯০-এর গণআন্দোলন, ’৯২-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, ২০১৩ সালের গণজাগরণেও তারুণ্যই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে আন্দোলনে। বর্তমান স্মরণকালের চার মেয়াদেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে আন্দোলন করেছে, দাবি আদায় করেছে। কখনো কোটা সংস্কারের দাবিতে, নিরাপদ সড়ক, কখনো ধর্ষণের প্রতিবাদে, কখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে। একবিংশ শতাব্দীর স্মার্ট তারুণ্য আন্দোলনকেও তুলে নিয়েছিল সৌন্দর্যের অনন্য উচ্চতায়। কোনো গাড়ি না ভেঙে, সহিংসতা না করেও যে দাবি আদায় সম্ভব, বারবার শিক্ষার্থীরা সেটা প্রমাণ করেছে। তবে ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের আন্দোলন এক পর্যায়ে সহিংস হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে সরকারও শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সরকারি চাকরি থেকে কোটা তুলে দিয়েছিল; কিন্তু হাইকোর্ট সরকারের সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করলে শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলনে নামে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে আমার নীতিগত কিছু মতভেদ আছে। প্রথম আমার মনে হয়েছে, কোটা সংস্কারের এ আন্দোলনের নামে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলনের মোটা দাগে কোটা ব্যবস্থাকে ভিলেন বানানো হয়েছে। কোটায় বৈষম্য সৃষ্টি হয়- এমন একটি ধারণা শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু আসলে বিশ্বজুড়ে কোটার ধারণা এসেছেই বৈষম্য নিরসনের জন্য। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৫ ভাগ কোটা বিদ্যমান ব্যবস্থায় একটু বেশিই ছিল। কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের সঙ্গে আমিও একমত ছিলাম। শুধু আমি নই, কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের সঙ্গে একমত ছিলেন প্রায় সবাই। কোটার সংস্কার চান না এমন একজন মানুষও দেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হাইকোর্ট কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন বাতিল করলে আবার প্রতিবাদ করে মাঠে নামে শিক্ষার্থীরা। রাষ্ট্রপক্ষও কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। তার মানে সরকারের চাওয়া আর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের চাওয়া ছিল সমান্তরাল। এমনকি হাইকোর্টের যে রায় নিয়ে এতকিছু, বিস্তারিত প্রকাশের পর দেখা গেল হাইকোর্টও বলছে, সরকার চাইলে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করতে পারবে। এমনকি আপিল বিভাগের অবস্থানও কোটা সংস্কারের পক্ষেই ছিল। এ ছাড়া সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীÑ সবাই কোটা সংস্কারের পক্ষেই বলছিলেন। সবার চাওয়া যখন অভিন্ন, তার পরও কেন এবারের আন্দোলন এমন পর্যায়ে গেল, সেটা সত্যি বিস্ময়কর ও দুর্ভাগ্যজনক।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কিছু কিছু পয়েন্টে ভিন্নমত থাকলেও তাদের মৌলিক আবেগ এবং তাদের আন্দোলন করার অধিকারের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। ২০১৮ সালেও শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের চেষ্টার প্রতিবাদ করেছি। তারুণ্যের আগের সব আন্দোলনের মতো এবারও তাদের আন্দোলনের অভিনব কৌশল আমাকে মুগ্ধ করেছে। এবার আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। শুরু থেকেই ১৪ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে ঢাকাসহ সারাদেশ অচল হয়ে গেলেও কোথাও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। ঢাকার অনেক পয়েন্টে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ব্লকেড সফল করতে সহায়তা করেছে। সরকার অসীম ধৈর্যের সঙ্গে আন্দোলন মোকাবিলা করেছে; কিন্তু ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান উঠলে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টে যায়। তবে আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায় ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করলে। ব্লকেড এবং রাজাকার স্লোগানে সাধারণ মানুষ আন্দলনকারীদের ওপর যতটা বিরক্ত ছিল, ছাত্রলীগের হামলার পর তা-ও পাল্টে যায়। তবে ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের নিহত হওয়ার ঘটনা, বিশেষ করে রংপুরে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে পুলিশের গুলি করে হত্যার ঘটনা আন্দোলনের জমে থাকা বারুদে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঘটায় যেন। আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে বেহাত হয়ে যায় আন্দোলন। বুধবার দুপুর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মাঠে থাকলেও এর পর থেকে আন্দোলন চলে যায় দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে। বুধবার বিকাল থেকে এই লেখা পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশে যা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের কাজ নয়। কোথাও আগুন লাগলে তাতে আলু পুড়িয়ে খাওয়ার মানুষের অভাব হয় না। পানি যখন যথেষ্ট ঘোলা হয়েছে, তখন তাতে মাছ শিকার করতে নেমে পড়ে একটি মহল। শিক্ষার্থীদের কাঁধে বন্দুক রেখে একটি মহল সরকারকে টার্গেট করে গুলি ছুড়তে থাকে।
আরও পড়ুন:
গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যাচ্ছে কেন
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকার কখনো টার্গেট ছিল না; কিন্তু বিএনপি যখন ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন করে মাঠে নেমে পড়ল, তখনই পাল্টে গেল পরিস্থিতি। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী বা মানুষের আন্দোলন এক বিষয়, আর দুর্বৃত্তদের নাশকতা আরেক বিষয়। যেভাবে একের পর এক সরকারি সম্পত্তি টার্গেট করে ধ্বংস করা হয়েছে; তা অবিশ^াস্য, অনাকাক্সিক্ষত, দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্র বিটিভি হামলার শিকার হয়নি। এবার সেই বিটিভি ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়েছে। ঢাকার মানুষের স্বস্তির অপর নাম মেট্রোরেলে হামলা করা হয়েছে। মেট্রোরেলের মিরপুর ১০ এবং কাজীপাড়া স্টেশন এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে, এ দুটি স্টেশন চালু হতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। শুধু বিটিভি বা মেট্রোরেল নয়, বেছে বেছে সরকারি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, বিদ্যুৎ অফিস, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, ময়লার গাড়ি, ইন্টারনেটের ডাটা সেন্টার, নরসিংদীতে কারাগারÑ রীতিমত তালিকা করে হামলা চালানো হয়েছে। টার্গেট ছিল গণমাধ্যম কর্মীরাও। শুধু বিটিভি নয়, বিভিন্ন বেসরকারি টিভি স্টেশনে হামলা চালানো হয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা প্রাণ দিয়েছেন। গণমাধ্যমের গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। এ হামলা যারা চালিয়েছে তারা শিক্ষার্থী নয়, আন্দোলনকারী নয়; এরা দুর্বৃত্ত, এরা জাতির শত্রু, এরা বাংলাদেশের শত্রু।
শুক্রবার মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পর থেকে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসছে। রবিবার আপিল বিভাগ ৫৫ ভাগ কোটা কমিয়ে ৭ ভাগ করার পর শান্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরাও। সোমবার এই লেখা যখন লিখছি, তখন সবকিছুই মোটামুটি শান্ত। হয়তো দুই-একদিনের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে, ইন্টারনেট চালু হবে, অফিস-আদালত খুলবে; কিন্তু মাঠের ৪/৫ দিনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তার ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন। আর্থিক ক্ষতির পুরো চিত্রটা আমরা এখনো জানি না। সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতি হয়তো হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে; কিন্তু আমি আর্থিক ক্ষতির চেয়ে মানুষের জীবনের ক্ষতিটা নিয়ে বেশি ব্যথিত। আর্থিক ক্ষতি এক সময় না এক সময় হয়তো পোষানো যায়; কিন্তু মানুষের জীবন অমূল্য। প্রতিটি মানুষের জীবনই অমূল্য। সেখানে এই কদিনে বিপুলসংখ্যক মানুষের খবর আসছে গাণমাধ্যমে। নিহতের তালিকায় শিক্ষার্থীরা যেমন আছে, আছে সাধারণ মানুষ, আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। এই সময়ে রাজপথে নৃশংসতার যে ছবি দেখেছি, তা আমাদের মনে গেঁথে থাকবে চিরদিন।
আরও পড়ুন:
বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ থাকবে, গণতান্ত্রিক দাবিতে রাজপথে আন্দোলন থাকবে; কিন্তু আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, দেশটা আমাদের সবার। দেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যায়, রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট হয়, মূল্যবান জীবন হারিয়ে যায়Ñ এমনকিছু করা কারও জন্যই শুভ নয়।
প্রভাষ আমিন : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ
আরও পড়ুন:
নিঃশব্দ আততায়ী কালো ধোঁয়া