আসন্ন মুদ্রানীতি কেমন হওয়া চাই

ড. আতিউর রহমান
১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আসন্ন মুদ্রানীতি কেমন হওয়া চাই

আর সপ্তাহখানিক বাদেই আসছে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি। মাত্র কদিন আগেই পাস হয়েছে বাজেট। বাজেটের নীতিকৌশলের সঙ্গে সমন্বয় করেই হয়তো দেওয়া হবে এই মুদ্রানীতি। তাই হওয়ার কথা। কেননা এই মুহূর্তের সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো শুধু রাজস্বনীতির মাধ্যমে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণেই আসন্ন মুদ্রানীতির ভঙ্গিটি কেমন হবে তা অনুমান করা যায়। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিকে দুই পায়েই হাঁটতে হবে। আর সে কারণেই সবার নজর থাকবে এই মুদ্রানীতির ওপর। বাজেটে স্পষ্টত মূল্যস্ফীতিকেই সামষ্টিক অর্থনীতির পহেলা নম্বরের চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আয়তন বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আট হাজার কোটি টাকার বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দ বাজেটে রাখা হয়েছে। তবে সম্প্রতি অন্তত আঠারোটি জেলায় বিরাজমান বন্যা পরিস্থিতির প্রভাবের কথা মনে রাখলে এই বিশেষ বরাদ্দ যথেষ্ট বলা যাবে না। গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। চলতি বাজেটেও তার ব্যত্যয় ঘটবে বলে মনে হয় না। তবে এবারের বাজেটকে নিশ্চয় সঙ্কোচনমূলক বললে ভুল হবে না। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ সামান্য হলেও কমানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাজেটকে আয় বুঝে ব্যয় করার সংস্কৃতির আদলে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে শেষমেশ এই লক্ষ্য কতটা পূরণ করা যাবে তার অনেকটাই নির্ভর করবে সংবেদনশীল বাস্তবায়নের ওপর।

এমনি এক প্রেক্ষাপটে এবারের মুদ্রানীতি যে সঙ্কোচনমূলকই হবে তা অনুমান করা যায়। অর্থনীতিবিদ ও পেশাজীবীদের সঙ্গে প্রাক-মুদ্রানীতি আলাপের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সে রকম ইঙ্গিতই দিয়েছেন। তবে এই সঙ্কোচনের মাত্রাটি কী হবে তা এখনই বলা মুশকিল। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো চাইবে এই মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় তার নীতি হার অন্তত পঁচিশ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে একটি সিগন্যাল দিতে। কিন্তু তাতে বাজারে সুদের হার আরেকটু বাড়বে। সেই ব্যথাটুকু উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা কি হজম করতে রাজি থাকবেন? নাকি তারা রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্দরমহলে কলকাঠি নেড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই কৌশলকে আটকে দেবেনÑ তাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে জুনে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সতেরো বেসিস পয়েন্ট কমেছে। বিশ্ববাজারেও জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতির পথ থেকে সরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও হয়তো সে পথেই হাঁটবে। সেসব বিষয় মাথায় রেখে হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক এবারের মুদ্রনীতিতে পলিসি রেট আর নাও বাড়াতে পারে। আরও কিছুদিন বর্তমান হারকেই ধরে রাখতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নীতির সঙ্গে আইএমএফ একমত নাও হতে পারে। তারা এরই মধ্যে নীতি হার আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে নয় শতাংশে উন্নীত করার পক্ষে মতামত দিয়েছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে যে, মূল্যস্ফীতি যদিও কমতির দিকে তবুও তা এখনো নয় দশমিক সাত দুই শতাংশ। তাই পলিসি রেট আরও খানিকটা বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে শক্ত অবস্থানে রয়েছে সেই ইঙ্গিতটি যেন দেয়Ñ এমন পরামর্শ আসছে আইএমএফের দিক থেকে। তবে আমাদের মতো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একা সব সিদ্ধান্ত নিতে গেলে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। তা ছাড়া শুধু সুদ বাড়িয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যে সম্ভব নয়Ñ সে যুক্তিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিতে পারে। সরবরাহ চেইনে সমস্যা থাকলে দেশে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা বেশ মুশকিল। সরবরাহ ঘাটতির কারণেও দাম বাড়ে। আর খাদ্য ছাড়া মসলাজাতীয় পণ্যের শুল্ক হার এখনো বেশি। গুঁড়োদুধ, ওষুধের কাঁচামাল আমদানি শুল্কও বেশি। তা ছাড়া ডলারের বিনিময় হার প্রায় তিরিশ শতাংশ বেড়েছে। তাই এসব পণ্যের দাম বাড়ন্ত। এই শুল্ক হার না কমালে এসব পণ্যের সরবরাহ ঘাটতিজনিত কারণেও তাদের দাম বাড়তিই থেকে যাবে। আর এই বিনিময় হার আরও খানিকটা যে বাড়তে পারে তেমন স্পেকুলেশন বাজারে আছে। সে কারণেও আমদানি করা পণ্যের দাম কমছে না। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কিছু করার নেই। তাই শুধু মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি বাগে আনা সহজ নয়। তবে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা নিয়ে যেভাবে পলিসি রেট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে নিম্নমুখী করতে পেরেছে সেটিও লক্ষ করার মতো। আশা করি এসব কিছু মাথায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক যথার্থ মুদ্রানীতিই দেবে।

তবে আমাদের কর-জিডিপির হার এখনো আট শতাংশের মতো। শ্রীলংকার এই হার এখনো ১২ শতাংশের বেশি। আর শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে টাকা ছাপিয়ে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে অর্থের জোগান দিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও এখন টাকা ছাপিয়ে সরবরাহ বন্ধ রাখছে। তবে আগে যে পরিমাণ টাকা ছাপিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তার মাল্টিপ্লায়ার প্রভাব এখনো বাজারে রয়ে গেছে। সে কারণে মূল্যস্ফীতি বাগে আনা চ্যালেঞ্জিং হবে বলেই মনে হচ্ছে। তাই উন্নয়ন বাজেটের আকার যদি আরেকটু সঙ্কোচন করা যায় তা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ধার নেওয়ার প্রবণতা কমবে।

তবে কৃষি ও খুদে উদ্যোগের জন্য পুনর্অথায়নসহ ভর্তুকি বাড়ানোর উদ্যোগ থেকে সরে আসার প্রয়োজন নেই। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী এই দুই খাতকে মনিটারি ও বাজেটারি সমর্থন দিয়ে যেতে পারলে বরং মূল্যস্ফীতির চাপ খানিকটা কমবে। এবারের মুদ্রানীতি দেওয়ার সময় প্রশ্ন উঠতে পারে যে, খেলাপি ঋণের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কী করবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়টি ছাড়াও ব্যাংকিং খাতের ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংক আস্থার অভাবের কারণে আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না তারা যেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করা অর্থের সাহায্যে বেশি বেশি ঋণ দিয়ে এডিআর রেশিও বাড়াতে না পারে সেদিকে কড়া নজর দিতে হবে। আর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠার যে আশ্বাস কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইপিবির দেওয়া রপ্তানির তথ্যের হিসাবের গরমিল ঠিক করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিশ্চয় প্রশংসনীয়। ফলে হয়তো গত অর্থবছরের তুলনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার খানিকটা কমে যাবে। তা যাক। কেননা এখন সময়টা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনার। প্রবৃদ্ধি নিয়ে এতটা ভাবার দরকার নেই। একইভাবে ঋণের হিসাবেও এমন গরমিল হয়তো আছে। সেটিও ঠিক করে ফেলার চেষ্টা নিশ্চয় বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারে। এসবের কারণে হয়তো সাময়িক খেলাপি ঋণের হার আরও বেড়ে যাবে। তাতে ভয় না পেয়ে পেশাদারি কায়দায় ব্যাংকিং খাতের সব তথ্য উপস্থাপন করাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের মূল কাজ। আশা করি তাদের এই পেশাদারত্বের চর্চার কারণে অচিরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে তাই এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে অর্থনীতিতে অস্থিরতা বাড়ে। অন্তত আরও ছয় মাস প্রবাসী আয়ের জন্য দেওয়া নগদ প্রণোদনা অব্যাহত থাকুক। তাতে প্রবাসীদের কাছে ডলারের প্রকৃত বিনিময় হার ১২০-১২১ টাকা মনে হবে। তাই তারা হুন্ডিতে না পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক পথেই ডলার পাঠাবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে হয়তো প্রণোদনা আরও বেশিদিন দিয়ে যেতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে বিদেশি ব্যাংকের স্বল্পকালীন ঋণের মাধ্যমে দেওয়া এলসি সুবিধাসহ সব ধরনের পেমেন্ট যেন সময়মতো শোধ করা হয় সেদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাড়তি নজর দিতে হবে।

আশা করি আসন্ন মুদ্রানীতি এমনভাবে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন ব্যাংকিং খাত নিয়ে যে আস্থার ঘাটতি তৈরির চেষ্টা কেউ কেউ বুঝে বা না বুঝে করছেন তার যেন উপযুক্ত জবাব দেওয়া সম্ভব হয়। তা হলেই বছর শেষে মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এবারের মুদ্রানীতি জনমনে আস্থার পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করুক সেই প্রত্যাশাই করছি।


ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর