জলাবদ্ধতার দায় কার
রাজধানীতে গতকাল শুক্রবার টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হয়েছে নগরবাসীকে। এদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ১৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এতে ঢাকার প্রায় সব এলাকাই জলবন্দি হয়ে পড়ে। গতকাল সন্ধ্যায়ও কোথাও কোথাও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজধানীতে এত বেশি জলাবদ্ধতা আর দেখা যায়নি।
নগরবাসীর অনেকের মনেই প্রশ্ন- এতো এতো উন্নয়নযজ্ঞের পরও ঢাকায় কেন এমন জলাবদ্ধতা? কেনইবা রাস্তার পানি সরতে এত দীর্ঘ সময় লাগছে? নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, জলাবদ্ধতার কারণ এ নগরীর দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষেরই জানা। কোন কোন পয়েন্টে জলাবদ্ধতা বেশি হচ্ছে তাও জানা। কীভাবে এর সমাধান করতে হবে, সেটিও চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু নিবিড় তদারকি এবং সমন্বিত ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণে রয়েছে তাদের অবহেলা। ড্রেনেজ নেটওয়ার্কগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করার ফলে পানি রাস্তায় জমে থাকছে; খালেও ঠিকমতো পানি অপসারিত হচ্ছে না। এ ছাড়া ময়লা আবর্জনায় ড্রেনগুলো সরু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি খুবই ধীরে অপসারিত হচ্ছে।
আগে ঢাকার খালগুলো ছিল ঢাকা ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ অন্যান্য সংস্থার হাতে। তখনো মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাস্তাগুলো হয়ে যেত নদীপথের মতো। তখন কথা উঠতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে না থাকায় জবাবদিহিতা নেই জলাবদ্ধতা নিয়ে। তাই সরকার ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওয়াসার অধীনে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর দুই সিটি করপোরেশন সময়ে সময়ে খাল উদ্ধারে তৎপর হয়। এ খাতে বিগত অর্থবছরগুলোতে পৃথক বরাদ্দও রাখা হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতার চিত্র বদলায়নি; কমেনি নগরবাসীর ভোগান্তি।
জলাবদ্ধতা হলেই সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়- মানুষ সচেতন নন। পলিব্যাগ, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতল ও কঠিন বর্জ্য রাস্তায় ফেলার কারণে পানি নামতে পারে না। আর বৃষ্টি হলে নগর কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়,
কুইক রেসপন্স টিম মাঠে নেমেছে।
গতকাল বিকাল ৫টায়ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এস এম হলের সামনে কোমর পর্যন্ত পানি দেখা গেছে। কিন্তু এই পানি নিষ্কাশনে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
কয়েক বছর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজে বের করে। তারা তখন বলেছিল অপ্রশস্ত ও নিচু কালভার্ট, অবৈধ দখল, কঠিন বর্জ্যে খাল ভরাট হয়ে যাওয়া, খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করা, খালের নির্গমন পথ সরু থাকায় পানি নিষ্কাশনে দেরি হয়ে আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া খালগুলো ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া, খালের নাব্য হ্রাস পাওয়া, পানি নিষ্কাশনে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকা, কালভার্টগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় পানি সরছে না। প্রয়োজনীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিদ্যমান ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব আমাদের সময়কে বলেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে গত ২৫ বছর ধরে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে সেগুলোর সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো মহাপরিকল্পনা করেনি। খালগুলোর সাথে কঠিন এবং তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে অঙ্গীভূত না করে খামচা-খামচি করে ছোট ছোট করে উদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সান্ত¡না দেওয়া হয়। প্রকৃত অর্থে পানি নেমে যাওয়ার নেটওয়ার্কটা উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয় না।
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার দুটি পথ; একটি হচ্ছে মাটিতে শুষে নেওয়া অন্যটি হলে ড্রেনের মাধ্যমে, খাল, জলাধারে নেমে যাওয়া। বাস্তব অর্থে উন্নয়নের নামে ঢাকাকে আমরা প্রায় পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছি। ফলে মাটিতে পানি যায় না। বিগত ২৫ বছরে সারফেস ড্রেন থেকে স্ট্রম ড্রেন, জলাধার, পুকুর খাল হারালাম। পুরো ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে কালভার্ট নামক জঘন্য অবলম্বনের মধ্য দিয়ে ঢেকে ফেললাম খাল। ফলে খাল ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হলো। হাতিরঝিলের মতো ছয়টি সুচিহ্নিত পানির আধার রয়েছে। ওয়াসা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড অধিগ্রহণ করা সত্ত্বেও সুরক্ষা দিতে না পারায় সেগুলো এখন দখলের মুখে। ফলে পানি কোথাও দাঁড়াতে পারছে না। যার ফলে জলাধারের পানি সড়কে আর সড়কের মাধ্যমে নগরের পানি নিম্নাঞ্চলে। সরকারের উচিত ছয়টি জলাধার দ্রুত উদ্ধার করা। অন্যদিকে ওয়াসার কাছ থেকে সিটি করপোরেশনকে খাল বুঝিয়ে দেওয়া হলেও গত ৩ বছরে দুই সিটি করপোরেশন দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়নি। সরকার আলাদা বরাদ্দও দেয়নি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত কয়েক দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এরই মধ্যে বিদ্যমান খাল ও নদী পানিতে ভরপুর। শুক্রবার হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ায় পানি অপসারণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে ঈদুল আজহার পর ড্রেন, খালে কোরবানির বর্জ্য ফেলা হয়েছে। তাছাড়া সড়কে প্লাস্টিকে বোতল, পলিথিন ব্যাগসহ কঠিন বর্জ্য পড়ে থাকলেও সিটি করপোরেশন ঠিকমতো তা পরিষ্কার করেনি। ফলে বৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। খাল উদ্ধার করলেও সেগুলো বর্ষার আগেই আবার ভরাট হয়ে যায়। হাতিরঝিলের একটা অংশ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ চলমান থাকায় নিউমার্কেট, পান্থপথসহ দক্ষিণ সিটির বড় একটি অংশের পানি নামার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের রামচন্দ্রপুর খাল উদ্ধারের কথা বলা হলেও এখনো পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। মোহাম্মদপুর গাবতলী এলাকায় থাকা বিশাল জলাধার ভরাট করে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন স্থাপনা নির্মাণ করার পাঁয়তারা করছে ফলে মিরপুর- মোহাম্মদপুর এলাকার পানি নামার জায়গা হারিয়েছে। তাছাড়া সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জলাবদ্ধ স্থানগুলোয় যেভাবে তৎপর হওয়ার কথা তা করা হয়নি। ফলে সড়কে পানি আটকে জলজটের সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
কামাল হোসেন নামে ধানমন্ডি এলাকার এক বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, আগে কখনো বাসার ভেতর পানি ঢোকেনি। এবার পানি ঢুকে অনেক জিনিস নষ্ট করেছে। সিটি করপোরেশনের মেয়ররা প্রায়ই বলেন, তারা খাল উদ্ধার করেছেন। খাল উদ্ধার করলে আর তারা কাজ করলে এমন হওয়ার কথা না। সব লোক দেখানো কাজ। মিডিয়াতে ছবি দেখানো একটা বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে নগরপিতাদের। শুধু মেয়র কেন? প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে নির্বাচিত কাউন্সিলর রয়েছেন পাশাপাশি নারী কাউন্সিলরও রয়েছেন। শুক্রবার বৃষ্টির পানি জমে থাকার পর কোনো জায়গায় কাউন্সিলর বা তার লোকদের দেখিনি। তাদের গাফিলতির কারণেই আজ আমাদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
দুই সিটি করপোরেশনের ভাষ্য
শুক্রবার বৃষ্টি শুরু হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রকৌশল বিভাগের ১০০ টিম মাঠে কাজ করছে। দ্রুত পানি অপসারণে তারা রাস্তায় থাকা ম্যানহোলের ঢাকনা ও ড্রেনের মুখ পরিষ্কার কাজে ন্যস্ত রয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছে তাদের ৫ হাজারের অধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করছে। এ ছাড়া ১০টি অঞ্চলে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে। তবে ডিএনসিসি এলাকার অনেক জায়গায় পানি জমে ছিল। গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় রাজধানীতে এক দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল ২২৪ মিলিমিটার। সেদিনও এতটা জলাবদ্ধতা দেখেনি ঢাকাবাসী।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান আমাদের সময়কে বলেন, জনগণকে কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন, শিগগিরই জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় নগরবাসীকে ভালো কিছু উপহার দেব। গতকাল ভারী বৃষ্টি হওয়ায় এই দুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের কাজের জন্য অনেকগুলো ড্রেনের ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার কারণে জলাবদ্ধতা বেশি। আমাদের খাল ভরাট হয়ে গেছে। যেসব খাল দখল হয়েছে সেগুলোর উদ্ধার ও খননকাজ চলমান রয়েছে। খালগুলো দখলমুক্ত হলে অনেকটা স্বস্তি পাওয়া যাবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছিম আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকা দক্ষিণের বাংলামোটর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের কাজের জন্য আমাদের ড্রেনের সিস্টেম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার কারণে এসব জায়গায় জলাবদ্ধতা একটু বেশি। আমাদের সবগুলো উইং কাজ করছে। তবে গতকাল শুক্রবার যে বৃষ্টি হয়েছে এবং তার পরে যে জলাবদ্ধতা হয়েছে এর জন্য আমরা নগরবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। নাগরিকদের সহায়তা পেলে আমরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারব।