পেনশন নিয়ে টেনশন

প্রভাষ আমিন
০৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
পেনশন নিয়ে টেনশন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রথম সর্বজনীন পেনশনের কথা বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম কথার কথা। নির্বাচন সামনে রেখেই হয়তো এই রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির আওয়াজ। ধারণা হিসেবে চমৎকার সন্দেহ নেই। আমার ধারণা ছিল, এই চমৎকার ও উচ্চাভিলাষী ধারণাটি বাস্তবায়িত হতে অনেক সময় লাগবে। এমনিতে আমি খুব আশাবাদী মানুষ। তার পরও আমার ধারণা ছিল সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা হয়তো এক সময় চালু হবে, কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও আমার একই শঙ্কা ছিল। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা প্রবল গণআন্দোলনের মাঠের কর্মী ছিলাম। কিন্তু সরকারের বিরূপ আচরণে এই বিচার বাংলার মাটিতে দেখে যেতে পারব, এমন আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা আমার সেই শঙ্কা ভেঙে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্ক ও গ্লানিমুক্ত করেছেন। শেখ হাসিনা আবারও আমাকে ভুল প্রমাণিত করলেন। উচ্চাভিলাষী মনে হলেও সবার জন্য পেনশনব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে বাংলাদেশে। এটা এক বিস্ময়কর অগ্রগতি। আমার বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সরকারের যত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তার সবার শীর্ষে থাকবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনা হবে বেশি। কিন্তু উপকারভোগীর সম্ভাব্য সংখ্যা বিবেচনায় এর চেয়ে বড় জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি আর কিছুই নেই। দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে গত বছরের ১৭ আগস্ট চালু করা হয় সর্বজনীন পেনশন। ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ, ২০৪১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ কোটি ১০ লাখে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্নআয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দিতেই সর্বজনীন পেনশনের ভাবনা। আগে থেকে চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বড় পার্থক্য হলো, পেনশন কর্মসূচিতে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। তাই এটা হবে সম্মানজনক এবং সবাই এটাকে নিজেদের কর্মসূচি মনে করবে। চলমান সামাজিক নিরাপত্তা এক ধরনের সাহায্য, আরও খারাপ করে বললে ভিক্ষা। আর সর্বজনীন পেনশন স্কিম বয়সী মানুষের মর্যাদার জীবন নিশ্চিত করবে। সত্যিকারের কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ার পথে বড় এক অগ্রগতি সর্বজনীন পেনশন স্কিম।

কিন্তু বছর পেরোনোর আগেই এই চমৎকার প্রকল্পটির মুখ থুবড়ে পড়ার দশা। সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়েছিল চারটি স্কিম নিয়ে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য ‘প্রগতি’, প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’, স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের জন্য ‘সুরক্ষা’ এবং স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ‘সমতা’। কিন্তু গত জুন পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন মাত্র ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৩ জন গ্রাহক। আমার বিবেচনায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম সরকার এবং গ্রাহক দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক। সরকার এখন শুধু টাকা পাবে। টাকা শোধ করার জন্য সময় পাবে সর্বোচ্চ ৪২ বছর। এই সময়ে পেনশন স্কিমের টাকা বিনিয়োগ করে সরকার আয় করতে পারবে। যে আয়ে পরে পেনশন শোধ করবে। কিন্তু এত চমৎকার একটি প্রকল্পে এত কম অন্তর্ভুক্তি কেন? আমার ধারণা প্রথমত, এই প্রকল্প নিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় প্রচার চালায়নি। সরকারি অন্য সব প্রকল্পের মতো চালু করেই খালাস। দ্বিতীয়ত, পেনশন স্কিম নিয়ে মানুষের অবিশ্বাস। এখন টাকা দিয়ে ৪২ বছর পর ঠিকমতো টাকা পাওয়া যাবে কিনা, এই অবিশ্বাসটাই এই স্কিমকে এগোতে দেয়নি। সরকারি কর্মচারীদেরই অবসরের পর পেনশনের টাকা পেতে জুতা ক্ষয় হয়ে যায়, সেখানে বেসরকারি চাকরিজীবীদের কী হবে? সরকার নিজেদের ঘাটতি মেটাতে জনগণের পকেট কাটার ব্যবস্থা করছে, এমন অপপ্রচারও ছিল। তার চেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তন হলে, নতুন সরকার এসে এই প্রকল্প রাখবে কিনা, সন্দেহ আছে তা নিয়েও। সমস্যা হলো সরকার সাধারণ মানুষের মধ্যে পেনশন স্কিম নিয়ে আস্থা তৈরি করতে পারেনি।

যাদের জন্য এই স্কিম চালু করা হলো, তাদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে না পেরে, সরকার এখন যারা পেনশন পাচ্ছিলেন, তাদেরও এই স্কিমের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। গোল বেধেছে সেটা নিয়েই। গত ১ জুলাই সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয়’ নামে আরেকটি প্যাকেজ চালু করা হয়েছে। স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যই ‘প্রত্যয়’। নতুন প্যাকেজে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ সব করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বিএসটিআইসহ প্রায় ৪০০ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অন্তর্ভুক্ত হবেন। আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘সেবক’ নামে আরেকটি প্যাকেজ চালু হবে। তার মানে আগামী বছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম সত্যি সত্যি সর্বজনীন হয়ে উঠবে। দেশের সব মানুষ অভিন্ন পেনশন কর্মসূচির আওতায় আসবে।

প্রত্যয় ও সেবকের ঘোষণা দেখে আমার মনে হলো, সরকার আসলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে সফল করতেই সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্মচারীদের এতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটা করা হয়েছে সহজে কর্মসূচিকে সফল করতে। কারণ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সাফল্য নির্ভর করে এর অন্তর্ভুক্তির ওপর। যত বেশি মানুষ এতে সম্পৃক্ত হবে, স্কিম তত সফল ও টেকসই হবে। কিন্তু প্রায় এক বছরে সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে না পেরে সরকার এখন এর আওতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এটা একদম আয়করের মতো। সরকার নিবন্ধিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহজেই আয়কর আদায় করতে পারে। সরাসরি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আয়কর নিয়ে নেয়। কিন্তু আয়কর দেওয়ার মতো আরও কোটি মানুষ এর আওতার বাইরেই রয়ে যায়। সরকার তাদের চিহ্নিতও করে না, আয়করের আওতায়ও আনে না। সেটা করতে পারলে আয়কর অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু আয়করের মতো পেনশন স্কিমকে সফল করতেও সরকার সহজ উপায়টাই বেছে নিয়েছে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্মীদের পেনশন স্কিমের আওতায় আনলে এক লাফেই স্কিমের সাফল্য নিশ্চিত হয়ে যাবে। কিন্তু মূলত যাদের জন্য এই স্কিম, সেই বেসরকারি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের অন্তর্ভুক্তির দিকে মনোযোগ না দিয়ে সফল করতে চাইলে স্কিমের মূল চেতনা বিঘ্নিত হবে।

প্রত্যয় স্কিম চালুর দিন থেকেই আন্দোলনে নেমেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা হিসাব করে দেখেছেন, প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থার বদলে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে গেলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রথম কথা হলো, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে পেনশন পেতে হলে সবাইকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে হবে। তা ছাড়া অবসরের পর এককালীন পাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে পেনশন শুরু হবে ৬০ বছর থেকে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫। প্রচলিত পেনশনে পেনশনভোগীর মৃত্যুর পরও নমিনি আজীবন পেনশন পান। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নমিনি পেনশন পাবেন ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত। নমিনি ৭৫ বছরের পর বেঁচে থাকলে কী করে বাঁচবেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এতসব অসঙ্গতি নিয়েই শুরু হয়েছে ‘প্রত্যয়’ স্কিম। তাই শুরুতেই পড়তে হয়েছে আন্দোলনের মুখে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। কিন্তু কমার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সুযোগ কমে যাবে। তাই যতই সরকার সমর্থক হোন, তারা সহজে এটা মেনে নেবেন না। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার শিক্ষক তথা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেননি। সর্বজনীন পেনশন স্কিমটাও চালু করা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। সব অসঙ্গতি দূর করে, সবার জন্য লাভজনক করে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা উচিত ছিল। তবে এখনো দেরি হয়ে যায়নি। এখন আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পেনশন স্কিমকে সত্যিকারের সর্বজনীন করে তোলা সম্ভব। আরও বেশি প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সরকারের এই চমৎকার উদ্যোগটি যেন কারও জন্য টেনশনের কারণ না হয়।


প্রভাষ আমিন : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ