বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘প্রত্যয়’ ও সবার প্রত্যাশা

ড. মো. শাখাওয়াৎ হোসেন ফিরোজ
০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘প্রত্যয়’ ও সবার প্রত্যাশা

১ জুলাই, ২০২৪ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামের একটি পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে যেটি ওই তারিখ থেকে এই পেশায় যোগদানকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। এটির গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর গত প্রায় তিন মাসের অধিক সময় ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষকরা এটি বাতিল করে বর্তমান পেনশন ব্যবস্থা চালু রাখার দাবিতে প্রতিবাদ ও প্রতীকী কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জুলাই থেকে এই কর্মসূচি সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে রূপ নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে কর্মরত কোনো শিক্ষকই ‘প্রত্যয়’-এর আওতাভুক্ত হবে না বা এই পেনশন ব্যবস্থায় তাদের অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন উচ্চশিক্ষার সম্ভাব্য আশঙ্কাজনক একটি ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্ট ও তার বিভিন্ন মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে এই প্রফেশনের উপর সবার অনেক ক্ষোভ বা বিরক্তি রয়েছে। অনেক নেতিবাচক মন্তব্যের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্ন। যেমনÑ

শিক্ষকরা কেন এখন আন্দোলন করছেন?

কেন ওই (বিশেষ এইটি) ঘটনার সময় তারা সমর্থন করেনি?

ওই বিষয়ের সময় তারা কোথায় ছিল? ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এই ক্ষোভ বা বিরক্তির কারণ জানতে আগ্রহী হয়েই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছি। একজন শিক্ষক হিসেবে এই প্রফেশনের সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে চাই। এই পেশার প্রতি সবার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাকটাও জানা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি কি শুধু একটি প্রফেশন নাকি আরও বেশি কিছু? দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক/রাজনৈতিক/সাংস্কৃতিক মতাদর্শের যুগের বর্তমান বাস্তবতায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে সামাজিক/রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে মতামত/সমর্থনের মতো প্রত্যাশার জায়গাটা কি বেশিই হয়ে যাচ্ছে না?

আপনারা শিক্ষকদের কোথায় দেখতে চান?

তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে নিয়ে যাবে?

কিন্তু এটিতো শুধু শিক্ষকতা নয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ব্যাপার, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিস্তারিত বলার সুযোগ রয়েছে।

আপনারা শিক্ষকদের কাছ থেকে কী শুনতে চান?

শিক্ষকরা জাতীয়/রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত/সমর্থন দেবে প্রয়োজনে বিরোধিতা করবে?

শিক্ষকরা সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদান করবে?

কিন্তু সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয় সবদিক থেকে প্রচণ্ডভাবে বিভক্ত এই আমাদের অন্যের বুদ্ধিবৃত্তিক মত কি আসলেই দরকার? কোনো মতামত/ভিন্ন দর্শন সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের বর্তমান সমাজ কাঠামোতে কি রয়েছে?

আর শিক্ষকরা কখন এসব করবেন? নিজেদের অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়েই তো বেশিরভাগ নাজেহাল। এই নাজেহাল শিক্ষক সমাজ নতুন করে কি ভাববে? একটা বিষয় জেনে রাখা দরকার, আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছে, বিশেষ করে সহযোগী অধ্যাপক বা তার উপরের পদে, তাদের বেশিরভাগেরই জীবনের গড়ে ৬ বছর কেটেছে উন্নত দেশে সব আধুনিক সুবিধাদি নিয়ে। আপনারা হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, একবার কোনো সুযোগে অভ্যস্ত হলে জীবন থেকে তা বাদ দেওয়া খুব সহজ নয়। ওই ব্যক্তি যখন এই দেশের বেতন কাঠামোর অর্থনৈতিক বলয়ে এসে পড়ছে তখন দেখছে কয়েক দিন আগে কাটিয়ে ওঠা তার অভ্যেসগুলোর ব্যবস্থা করা খুবই দুরূহ। গরমে ঘুমানো জন্য এসি, পরিবারের জন্য একটি গাড়ি এবার তার জন্য বিশাল বিলাসিতা। তিনি কিন্তু গাড়ি/গাড়ির জন্য ভাতা/ড্রাইভারের বেতন চাচ্ছে না। নিজের একটি বাড়ি থাকবে সেটা একটা কল্পনা মাত্র। তিনি কিন্তু স্বল্প দামে একটি প্লট/বাড়ি বা শিক্ষকদের আবাসনের জন্য বিশেষ এলাকা বরাদ্দ চাচ্ছে না। আপনারা দেখবেন বাংলাদেশে যারা নিজেদের গাড়ি নিজেরা চালান তাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কারণ একজন ড্রাইভারের বেতন দেওয়াটা তার কাছে সহজ ব্যাপার নয়। অনেকেরই ধারণা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কন্সালটেন্সি করে তো অনেক টাকা কামাচ্ছে শিক্ষকরা। আমি বলব আপনাদের ধারণা নেই ঠিক প্রতি মাসে ঠিক কত টাকা এভাবে আয় করা সম্ভব বা শতকরা ঠিক কতজন এটা করতে পারছে। এমন দুর্দশাগ্রস্ত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান, মতপ্রকাশ বা জ্ঞান সৃষ্টির প্রত্যাশা আসলেই বেশি নয়? আমার বিশ্বাস অর্থনৈতিক পরাধীনতা একজনের চিন্তার স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রক।

যা হোক, চলমান আলোচিত বিষয়টি নিয়ে আর একবার আলোকপাত করা যাক। ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রেখে এমন একটি অচলাবস্থা কি কারও কাম্য হতে পারে? উত্তর হবে, অবশ্যই না।

‘প্রত্যয়’ নামের এই পেনশন ব্যবস্থায় বর্তমানে কর্মরত কোনো শিক্ষকের জন্যই প্রযোজ্য না হলেও কেন এই আন্দোলন চলছে?

কার জন্য এই আন্দোলন?

শিক্ষা প্রশাসন/ব্যবস্থাপনা বা সংশ্লিষ্ট সবার গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার শিক্ষকরা কি বলতে চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিন বদলের সনদ বাস্তবায়ন/স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এত গুরুত্বহীন মনে করার কি কোনো বিশেষ কারণ আছে? দীর্ঘ সাড়ে তিন মাসের চলমান এই আন্দোলনে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের যোগাযোগ বা আলোচনার উদ্যোগ না নেওয়া কি উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই সেক্টরের প্রতি সুস্পষ্ট অবহেলা নয়? আর সেটা জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য যথেষ্ট নয় কি? আবার সেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে দেখতে চাওয়াটি কি যুক্তিযুক্ত?

শিক্ষকতা ও গবেষণার দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কাক্সিক্ষতদের দেশে ধরে রাখতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে শিক্ষকতা পেশায়ও এই সংকট দৃশ্যমান। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলয়ের এই অস্থির সময়ে ‘প্রত্যয়’-এর অন্তর্ভুক্তি উচ্চশিক্ষায় ব্যাপক সংকট তৈরি করবে তা নিশ্চিত বলে আমার মনে হয়। দেশকে আমরা কোথায় দেখতে চাই, সেই উন্নয়নকে কতটা টেকসই করতে চাই তা নির্ভর করবে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমাদের পলিসি, পরিকল্পনা ও ইনভেস্টমেন্ট।

পলিসি তৈরির বিজ্ঞান (ঝপরবহপব ড়ভ ঢ়ড়ষরপু সধশরহম) অনুযায়ী পলিসি প্রস্তুতি ও তার বাস্তবায়ন কিন্তু এক নয়। পলিসি তৈরির জন্য দরকার গবেষণা, তথ্য ও উপাত্তের বিশ্লেষণ এবং স্টেক হোল্ডারদের সংযুক্তি। সারা বিশ্বেই একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পলিসি তৈরি হয়। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনার এই পেনশন কাঠামো তৈরিতে এটি সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন নিয়ে এই তাড়াহুড়ো না করে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার সঙ্গে এর সমন্বয় করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই কাঠামো তৈরি জরুরি ছিল। যে কোনো পলিসি তৈরি ও এর ব্যবস্থাপনায় পেশাজীবীদের/বিজ্ঞজনের সম্পৃক্ততা না থাকলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি দোষারোপের সংস্কৃতি একটি সামাজিক ও মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত আমরা শুধু অন্যের সমস্যা দেখতে পাই। আর তাই আমি নিজেদের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার জায়গাটি বুঝতে চাচ্ছি। প্রত্যেক পেশার একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং বাংলাদেশের মতো দেশের বাস্তবতায় সবার সীমাবদ্ধতাও আছে। উপরন্তু পেশাজীবীদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটিতে অনেক ঘাটতিও বিদ্যমান। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন নিজেদেরকে ভিন্ন জায়গায় ভিন্নভাবে দেখতে চাইব তখন নিজেদেরকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে জানতে হবে, তার সঙ্গে ভাবতে হবে অন্যদের প্রত্যাশার জায়গাটি নিয়ে। দিন বদলের কর্মযজ্ঞে সব পেশা ও মত নিয়ে সবার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে আগামী প্রজন্মের স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে।


ড. মো. শাখাওয়াৎ হোসেন ফিরোজ

অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়