ভারতের চ্যাম্পিয়নশিপে কোনো খাদ নেই
বারবাডোজে অনুষ্ঠিত ঘটনাবহুল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের কথা ক্রীড়ামোদীদের মনে থাকবে অনেক অনেক দিন। প্রচণ্ড উত্তেজনার দোলাচলে শেষ পর্যন্ত ভারত ৭ রানে জয়ী হয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন শিরোপা লাভ করে। কিন্তু একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে কীভাবে দলকে সাফল্যের সিঁড়িতে নিতে হয় তা ভারত প্রমাণ করেছে। বিপরীতে সমালোচিত হতে হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এত সহজ সুন্দর সুযোগ এভাবে হাতছাড়া হতে পারে এটি এখনো অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য। তবে এ রকম ম্যাচে নিয়তিকে কোনোভাবেই তাচ্ছিল্য করার উপায় নেই। আসলেই ভারতের পক্ষে ভাগ্য ছিলÑ যা ছিল না দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে। আর এ কারণেই কপালে লেখা জয় হাতের মুঠোতে পেয়েও ধরে রাখতে না পারার যে নিরন্তর দুঃখ তা বয়ে বেড়াতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। আর ভারত কোনো ম্যাচে না হেরে প্রমাণ করেছে তারাই শ্রেষ্ঠ, তারাই সবার ওপরে। অথচ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত আদৌ জিততে পারবে কিনা এ নিয়ে ছিল ঢের সংশয়। তবে সব ভয়-সংশয় কাটিয়ে দুর্দান্ত এক লড়াই শেষে ভারতই চ্যাম্পিয়ন।
ফাইনালে খেলার শেষ পর্যায়ের ধারায় জয় পাওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকারই। কিন্তু ম্যাচের অন্তিমলগ্নে বাউন্ডারি লাইনে সূর্যকুমার যাদবের নেওয়া অসাধারণ এক ক্যাচ-ই ভারতকে দুর্দান্তভাবে জয় নিশ্চিত করে। ১৯.১ ওভারের সময় ভারতের হার্দিক পান্ডিয়ার করা বলে দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার সজোরে মারলে বল বাউন্ডারি সীমানা পার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ফিল্ডার সূর্যকুমার যাদব অনেকটাই দ্বিতীয় চেষ্টায় অতিমানবীয় কায়দায় ক্যাচ তুলে নেন। মিলার আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বল আর রানের সমীকরণে অনেকটাই ভারতের চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত হয়ে যায়। আর দক্ষিণ আফ্রিকার হাতের মুঠো থেকে নিশ্চিত জয় ছুটে যায়।
ম্যাচে ভারতের ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান ক্লাসেনের ব্যাটিং ছিল অনবদ্য, আকর্ষণীয় এবং অনিন্দনীয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভারতের ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি-ই প্রস্ফুটিত হয়েছেন। দেশের পরাজয়ের কারণে ক্লাসেনের করা ২৭ বলে ৫২ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটি ক্রীড়ামোদীদের চোখের সামনে ঘুরলেও সেটি ধ্রুপদী হতে পারল না। ১৯২.৫৯ স্ট্রাইকে ক্লাসেনের পাঁচ ছক্কা আর দুই চারের কারণে প্রাপ্ত ৫২ রানই দক্ষিণ আফ্রিকার বিজয়ের শত সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। ক্লাসেন ফিরে যাওয়ার সময় জয়ের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল তখন ৩০ বলে ৩০। এটি ছিল অনেকটাই পানির মতো ব্যাপার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা তীরে এসে তরী ডুবিয়ে ফেলে। আর তাই ক্লাসেন নয়, বিরাট কোহলি এখন পুষ্পশোভিত হচ্ছেন সর্বত্র। যদিও এই আনন্দময় শুভক্ষণে ভক্তদের তিনি কিছুটা ধাক্কা দিয়েছেন অবসরের ঘোষণা দিয়ে। তবে তার আর কোনো অতৃপ্তি নেই। তিনি এটাই চেয়েছিলেন।
কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো তার। বিরাট কোহলির বেলায় সেটাই ঘটেছে। ফাইনালের আগে তেমন একটা রান পাননি। ফাইনালের আগে ৭ ম্যাচ খেলে রান করেছিলেন মাত্র ৭৫। শুধু বাংলাদেশের বিপক্ষেই সবচেয়ে বেশি ২৮ বলে ৩৭ রান করেছিলেন, যেখানে স্ট্রাইক রেট ছিল ১৩২.১৪। ফলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল বেশ। অনেকেই ভরসা করতে পারছিলেন না। আড়ালে-আবডালে কথাও হচ্ছিল। কোহলির ব্যাটে রান দেখতে না পেয়ে সাবেক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার কোহলিকে কিছু টিপস দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কোহলি যেন মাঠে শান্ত থাকে এবং শরীরের ভারসাম্য ঠিক রেখে খেলেন। আর ফাইনালের আগে কোহলির ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে অধিনায়ক রোহিত বলেছিলেন, ‘ও সবকিছু ফাইনালের জন্য জমিয়ে রেখেছে।’ ভারতের কোচ কুল ম্যানখ্যাত রাহুল দ্রাবিড়ও ঠিকই তাকে আস্থায় রেখেছিলেন। আর সেই আস্থার প্রতিদান দিতে ভুল করেননি কোহলি। ফাইনালের দিন অধিনায়ক রোহিত শর্মা আউট হওয়ার পর কোহলি ক্রমেই আলো ছড়াতে থাকেন। আউট হওয়ার আগে ৫৯ বলে ৭৬ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস উপহার দিয়ে যান। যেখানে ছিল ছয়টি চার এবং দুটি ছয়ের অনবদ্য প্রদর্শনী। আর কোহলির এই রানের ওপরে ভর করেই ভারত সবমিলিয়ে করে ১৭৬ রান। তবে ফাইনালে এক আগ্রাসী কোহলিকে দেখতে পান দর্শকরা। যিনি এই বিশ্বকাপের বিগত সাত ম্যাচের নিজের পরিসংখ্যান ছিঁড়েফুড়ে স্বমহিমায় ফিরে আসেন। কোহলিকে নিয়ে এখন আলোচনার শেষ নেই। ভারতের মিডিয়াগুলো এখন তার গুণকীর্তনে মত্ত। ২০১০ সালের ১২ জুন টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক ঘটেছিল কোহলির। তার সেই অভিষেককালে বীরেন্দ্র সেহবাগ, গৌতম গম্ভীর, যুবরাজ সিং তখন চব্বিশ গজের যুদ্ধে টপফর্মে। ভারতের এসব আকর্ষণীয় দুর্দান্ত ক্রিকেটারদের দিকে তখন সবার নজর। কোহলি তখন ছোট্ট এক ক্রিকেটার। এর পর কত অনবদ্য ম্যাচ খেলেছেন তিনি। কিন্তু এই বিশ্বকাপে এঁটে উঠতে পারছিলেন না। আর যখন স্বরূপে উদ্ভাসিত হলেনÑ তখন ভারতের জন্য তা হয়ে এল আশীর্বাদ হয়ে। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কোহলির টোটাল রান ৪১৮৮। মোট ম্যাচ খেলেছেন ১২৫টি। স্ট্রাইক রেট ১৩৭.০৪। একটি শতরানসহ হাফ শতক মেরেছেন ৩৮টি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ভারতের চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভারতের সাবেক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার আগেই বলেছিলেন এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলবে ভারত। আর প্রতিপক্ষ থাকবে পাকিস্তান নয়, অস্ট্রেলিয়া। ভারত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর গোটা ভারত আনন্দ-উল্লাসে কাঁপছে। ভারতের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চমৎকার দলীয় সংহতি আর কমিটমেন্টের কারণে ভারত প্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছে। এটি একটি দুর্দান্ত টিম ওয়ার্ক। তবে ভারতের বিজয়ে পাঁচটি কারণকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আনন্দবাজার অনলাইন। এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ সামনে থেকে অধিনায়ক রোহিতের নেতৃত্ব দেওয়া, প্রতিযোগিতাজুড়ে বোলার আরশদীপের দুর্দান্ত বোলিং, বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে দলের মানিয়ে নেওয়া, স্পিন বোলিংনির্ভর আক্রমণ করা এবং ওপেনিং জুটির ওপর ভরসা করা। বলা হচ্ছে এগুলোর ওপর ভর করেই ভারত কাক্সিক্ষত জয় পেয়েছে। আর এই জয়ের পেছনে ‘কুল ম্যান’খ্যাত কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের রয়েছে অসামান্য অবদান। অবশ্য রাহুল দ্রাবিড়ও নিজ দায়িত্ব থেকে স্বইচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে কোচ হিসেবে রাহুলের প্রাপ্তিটাও ইতিহাস হয়ে থাকল। কেননা খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় এমন কোনো শিরোপার দেখা তিনি পাননি। ফলে কোচ হিসেবে তিনি সার্থক হলেন। প্রধান কোচ হিসেবে তার সাফল্য অনেক। তার জয়ের শতকরা হার ৬৮.৭০ শতাংশ। তার অধীনে ভারতীয় ক্রিকেট দল মোট ৭০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে জয়ী হয়েছে ৫১টিতে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হলো। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ক্রীড়ামোদীদের অতৃপ্তির কিছু নেই। ফাইনালের আগে যা যা অতৃপ্তি ছিল তার পুরো স্বাদ পেয়েছে ফাইনালে। আর এবারের ফাইনাল ম্যাচ যেন ক্রীড়ামোদীদেরও আনন্দ-উপভোগের জায়গাতেও বড় বেশি আগ্রাসী করে তুলেছে। এমন খেলার বাইরে যেন আর কিছু কাম্য নয়। এ কথা সত্য যে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এখন এতটাই গতিময় যে টেস্ট-ওয়ানডে থেকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ক্রিকেটে ক্রীড়ামোদীদের চোখ এখন সবচেয়ে বেশি আটকে থাকে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাট-বলের লড়াই যে আগামী দিনে আরও ভয়ানক হবেÑ তা যেন এবারের ফাইনাল বলে দিয়ে গেল। এখন সেভাবেই তৈরি হতে হবে সব দলকে। দলে একজন বিরাট কোহলি বা একজন ক্লাসেন না থাকলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব হবে না। এবারের ফাইনাল সে কথাই বলে গেল।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
জাহিদ রহমান : ক্রীড়া লেখক ও গবেষক