হলি আর্টিজানের আগে-পরে
১ জুলাইয়ের সেই নারকীয় ঘটনা কোনোদিন আমার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না। দিনটি ছিল শুক্রবার, আমার ছুটির দিন। তখন রমজান মাস। ইফতারের পর সপরিবারে বেরিয়েছিলাম। প্রথম ফোন পেলাম এটিএন নিউজের পরিচালক সৈয়দ সামিউল হকের। তিনি বললেন, গুলশানের দিকে মনে হয় কিছু একটা হয়েছে। অফিসে খোঁজ নিলাম, তারাও শুনেছে; কনফার্ম নয়। এর পর একের পর এক ফোন আসতে থাকে। তখনো কেউ নিশ্চিত নয় কী ঘটেছে, শুধু এটুকু জানা যাচ্ছে, কিছু একটা ঘটেছে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, ভয়ঙ্কর কিছু একটা হয়েছে। দ্রুত স্ত্রী ও সন্তানকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে অফিসে ছুটে গেলাম। তার পর গোটা জাতির সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর ১২ ঘণ্টা যাপন। ৮ বছর পর এসেও সবকিছু একদম টাটকা যেন। সেদিন সাংবাদিকতাটাও অনেক কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। প্রতিরোধের প্রথম চেষ্টাতেই প্রাণ হারান দুই পুলিশ সদস্য। তাই সাহসী সাংবাদিকদেরও খুব কাছে গিয়ে জানার বা দেখার সুযোগ ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলতে হয়েছে সবাইকে। আটকেপড়া মানুষের কারও কারও ফোনকলও সম্প্রচার করেছেন কেউ কেউ। সেটা নিয়েও বিতর্ক ছিল। এর মধ্য দিয়ে তাদের অবস্থান আমরা জঙ্গিদের জানিয়ে দিচ্ছি না তো। শুধু আমি নই, আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের কোনো মানুষই ২০১৬ সালের ১ জুলাই দিনটি ভুলতে পারবেন না। বাংলাদেশে অতীতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, আশা করি ভবিষ্যতেও ঘটবে না। বৈশ্বিক মানদণ্ডে ২০০১ সালে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার যতটা প্রভাব, বাংলাদেশের বাস্তবতায় হলি আর্টিজানের প্রভাব তার চেয়ে কম নয়। বিদেশি নাগরিক, বিশেষ করে জাপানের নাগরিকরা প্রাণ হারানোয় বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল দেশের ভাবমূর্তির। জঙ্গিবাদের অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল তাদের সফর বাতিল করেছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের তালিকায় উঠে গিয়েছিল বাংলাদেশের নাম। আর হামলাকারীরা এটাই চেয়েছিল। হলি আর্টিজানে হামলার আগের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক নয়, হলি আর্টিজানে হামলা বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। হামলাকারীদের কোনো দাবি ছিল না, কোনো মুক্তিপণ ছিল না। তারা শুধু সবার নজর কাড়তে চেয়েছিল। তবে এখানেই তারা সবচেয়ে বড় ভুলটি করেছিল। সবার সঙ্গে নজর কেড়েছিল যমদূতেরও। হলি আর্টিজানের পর বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। ফলাফলÑ বাংলাদেশ এখন জঙ্গিবাদের ঝুঁকিমুক্ত।
তবে বাংলাদেশ কি একেবারেই জঙ্গিমুক্ত? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজব পরে। জঙ্গিবাদ কী, জঙ্গি কারা; এই নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক কথা হয়েছে। আমি সহজ করে দুই লাইনে বলি, যারা নিজেদের মত-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে তারা মৌলবাদী; যারা গায়ের জোরে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা কট্টর মৌলবাদী। আর যারা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠায় অস্ত্র হাতে তুলে নেয় তারাই জঙ্গি। দুর্ভাগ্যজনক হলো অনেক বছর ধরে জঙ্গিবাদের সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ মানে ইসলাম, জঙ্গি মানেই মুসলমানÑ পশ্চিমারা সুকৌশলে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তালেবান, আল কায়েদা, আইএসের মতো সংগঠন সেই ধারণাকে আরও পোক্ত করেছে। টুইন টাওয়ার বা হলি আর্টিজানে হামলাও সেই ধারণাকেই যুক্তি দেয়। এটা ঠিক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বঞ্চিত হতে হতে মুসলমানদের মধ্যে প্রতিশোধপরায়ণতা একটু বেশি। তাই ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে দ্রুত। তবে জঙ্গিবাদ মানেই ইসলাম নয়। সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষ জঙ্গি হতে পারে। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলাকারী কিন্তু শ্বেতাঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক শ্বেতাঙ্গ মৌলবাদী বা কট্টর মৌলবাদী আছে, যাদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে। পাশের দেশ ভারতে অনেক মৌলবাদী বা কট্টর মৌলবাদী হিন্দু আছে। তাদের অনেকেও জঙ্গি হতে পারে। তাই জঙ্গি মানেই মুসলমান, এই ধারণাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাস বেশ পুরনো। আশির দশকে বাংলাদেশের অনেকেই আফগানিস্তান গিয়ে রাশিয়ান সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৯২ সালে আফগান ফেরত মুজাহিদরা গড়ে হরকাতুল জিহাদ। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানো। হরকাতুল জিহাদই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়েছে। তার পর বিভিন্ন সময়ে জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, আল কায়েদা নানান নামে জঙ্গিরা তৎপরতা চালিয়েছে। জঙ্গিরা ভিন্নমতাবলম্বী ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, এমনকি ইসলামি বক্তা বা পীরদের হত্যা, রমনায় বর্ষবরণ, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, দেশজুড়ে একযোগে বোমা হামলা, আদালতে বোমা হামলাÑ জঙ্গিদের অপকর্মের তালিকা অনেক লম্বা। এমনকি শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে গ্রেনেড হামলার অপারেশনটাও জঙ্গিরাই করেছে, যদিও তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থন ছিল। শুধু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নয়, ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর শাসনকালে শায়খ আবদুর রহমান আর বাংলাভাই রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় ভিন্ন ধরনের এক জঙ্গিবাদ চর্চা করে। সব জায়গায় জঙ্গি মানেই গোপন, জঙ্গিবাদ মানেই নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাভাই প্রকাশ্যে মানুষ মেরে গাছে ঝুলিয়ে রাখত। তবে বিএনপি আমলেই ফাঁসি হয়েছিল সেই জঙ্গিদের। আমি সব সময় প্রকৃতির বিচারে বিশ্বাস করি। পাপের পেয়ালা যখন পূর্ণ হয়ে যায়, প্রকৃতি তখন শোধ নেয়। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহও পছন্দ করেন না। বাংলাভাই বাড়াবাড়ি করে মরেছে। বাংলাদেশের জঙ্গিরাও বাড়তে বাড়তে হলি আর্টিজানের চূড়ায় উঠেছিল, তার পর শুরু হয়েছে অবশ্যম্ভাবী পতন। বাংলাদেশে আরেকটা ধারণা প্রচলিত ছিল, জঙ্গি মানেই মাদ্রাসাছাত্র আর মাদ্রাসায় শুধু জঙ্গিবাদের চর্চা হয়। কিন্তু হলি আর্টিজান প্রমাণ করেছিল, ইংলিশ মিডিয়াম, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ধনীর দুলালরাও জঙ্গি হতে পারে। কার ব্রেন কোথায়, কীভাবে ওয়াশ হয়ে যাবে; তার কোনো ঠিক নেই। চার দশকের বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালিয়েও জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে শিকড় গাড়তে পারেনি। কেন? কারণ বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মানুষ মুসলমান হলেও তারা ধর্মান্ধ নয়। ধর্মের নামে তাদের দিয়ে কোনো অন্যায় করিয়ে নেওয়া সহজ নয়। একাত্তর সালে ধর্মের দোহাই দিয়েও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়নি। জঙ্গিরাও তেমনি কখনই জনগণের সমর্থন পায়নি। আর যে কোনো মত, পথ, ধর্ম, রাজনীতি, তত্ত্বের সাফল্য নির্ভর করে গ্রহণযোগ্যতার ওপর। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশে কখনই জঙ্গিরা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তবে এতে তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ জঙ্গি হামলার জন্য অনেক মানুষ লাগে না। একজন ‘লোন উলফ’ বা ‘স্লিপার সেলে’র সদস্য একাই আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে। হলি আর্টিজানের পর সরকারের টানা অভিযান তছনছ করে দিয়েছে বাংলাদেশের জঙ্গি নেটওয়ার্ক। এ অভিযান অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে বিপদ কিন্তু যায়নি। এখনো নানা নামে আড়ালে-আবডালে জঙ্গিবাদের চর্চা হচ্ছে। কারণ একবার কারও ব্রেনওয়াশ হয়ে গেলে তাকে ফেরানো কঠিন। আগে মাদ্রাসায় বা মসজিদে জঙ্গিরা রিক্রুটমেন্টের চেষ্টা করত। এখন ইন্টারনেট তাদের কাজ সহজ করে দিয়েছে। এখন সহজে যোগাযোগ করা যায়, মোটিভেট করা যায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে কিন্তু ভয়টা তবু যায় না। ভয়ের বড় কারণ হলো রাজনৈতিক শূন্যতা। আসলে ১৮ থেকে ২৫ এই বয়সটা খুবই বিপজ্জনক। এই বয়সে কিছু না কিছু করতে চায়। একাত্তর সালে এই বয়সের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। স্বাধীনতার আগে-পরে তরুণদের একটা বড় বাম রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়, অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে বিভিন্ন সংগঠনে জড়ায়। স্বাধীনতার পর পর তরুণদের একটা বড় অংশ জাসদে যোগ দিয়ে বিপ্লব করতে চেয়েছিল।
আশির দশকে এই তারুণ্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। রাজনীতিবিমুখ তরুণরাও এক সময় নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতো। কিন্তু এখন তারুণ্যের সামনে কোনো মহৎ লক্ষ্য নেই। কিন্তু তাদের রক্তে আছে উন্মাদনা। জঙ্গিদের জন্য তাই তরুণদের আকৃষ্ট করা বা ব্রেনওয়াশ করা সহজ হয়। আমি জানি, বিশ্বাস করি বাংলাদেশে আর কখনো হলি আর্টিজানের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু সেটা শুধু আকাক্সক্ষা করলেই হবে না। যাতে না হয় সেজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে লখিন্দরের বাসরঘরেও কিন্তু সাপ ঢুকেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, নির্মূল করা যাবে না। তাই তরুণদের সামনে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের লক্ষ্য দিতে হবে। ধর্মীয় মৌলবাদকে কোনো প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে তরুণদের ভালোবাসতে শেখাতে হবে। সে ভালোবাসবে নিজেকে, দেশকে, মানুষকে, জীবনকে। তা হলেই কেউ পরকালের ভয় দেখিয়ে তার ব্রেনওয়াশ করতে পারবে না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
প্রভাষ আমিন : বার্তাপ্রধান এটিএন নিউজ
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!