হাতিয়া দ্বীপে বাউবির সেবা ও শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন
সাগর দ্বীপ হাতিয়া জনপদের মানুষ নিজেদের শিক্ষিত, কর্মমুখী ও স্বাবলম্বী করতে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার জন্য কর্মমুখী, গণমুখী ও জীবনব্যাপী শিক্ষা ব্যবস্থাকে। সাগরে বুকে নানা প্রতিকূলতার মাঝেই জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে হয় পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী রুনা লায়লাকে। সেই সাথে সমাজে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা।
সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকায় তিনি লজ্জা বোধ করেন। মনে মনে পণ করেন নিজে উচ্চ শিক্ষিত হবেন এবং সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে হাতিয়ার জনপদে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচবেন। ভর্তি হন বাউবির এসএসসি প্রোগ্রামে। তিনি এবার নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের সুখচর ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাউবি পরিচালিত এস এস সি পরীক্ষা দিচ্ছেন। তার মেয়েও এ বছরে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। রুনা লায়লা একজন শিক্ষিত মা ও শাশুড়ি এবং একজন সফল উদ্যোগতা হতে চান।
জনপ্রতিনিধি মফিজুর রহমানের বয়স পঞ্চান্ন বছর। তিনি আট সন্তানের জনক, নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। স্কুল ও মাদ্রাসাসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে সভাপতি বা জনপ্রতিনিধিত্ব করতে হলে ন্যূনতম এসএসসি পাস হতে হয়। সার্টিফিকেট না থাকার কারণে ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে পারেননি। এলাকায় তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে তিনি বাউবি থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করে একজন যোগ্য জনপ্রতিনিধি হতে চান।
দ্বীপ জনপদের তিন সন্তানের জননী বত্রিশ বছর বয়সী বিধবা মারজান বেগমের সংসার চলে অনেক প্রতিকূলতার মাঝেই। তিনি হাতিয়ায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ছেলে মেয়েদের এবং নিজের লেখাপড়ার খরচ চালান। এসএসসি পাস করলে তার একটি প্রমোশন হবে। তিনি বাউবি থেকে লেখাপড়া করে নিজে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চান একই সাথে সন্তানদের মানুষ করবেন।
পঞ্চান্ন বছর বয়সী হেলাল উদ্দিনের পুত্রবধূরা ডিগ্রিধারী। তিনি একজন ইউপি সদস্য। লেখাপড়া কম জানায় পুত্রবধূদের কাছে সংকোচবোধ করেন। তিনি লেখাপড়া ও ডিগ্রি লাভ করে একজন শিক্ষিত বাবা ও শ্বশুর এবং একজন ভালো রাজনীতিবিদ হতে চান।
প্রাইমারি স্কুলের প্রহরী চল্লিশ বছর বয়সী শরীফ উদ্দিনের সংসার চলে অনেক টানাপোড়নের মাঝে। এসএসসি পাস করলে একটি প্রমোশন বা উচ্চ পদে দরখাস্ত করতে পারবেন। বাউবির মাধ্যমে লেখাপড়া করে তিনি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কামাল উদ্দিনের অনুপ্রেরণায় ভর্তি হয়েছেন বাউবিতে। কামাল উদ্দিন ও বাউবির প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তার কাছে বাউবি কর্মমুখী মানুষের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান।
ত্রিশ বছর বয়সী মায়মুনা বেগম একজন সেলাই শিল্পি ও উদ্যোক্তা। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে সেলাই প্রশিক্ষণের জন্য গেলে এসএসসি পাস না থাকায় তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি। মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে এসে ভর্তি হন বাউবির এসএসসি প্রোগ্রামে। বাউবির মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চান। তিনি জানান লেখাপড়া কম জানলে কোন কাজে ভাল সফলতা আসে না।
চার সন্তানের জননী একত্রিশ বছর বয়সী আসমা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সেখানে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করতে দেখে তার নিজেরও ইচ্ছে হয় লেখা পড়া করে নতুন জীবন গড়ার। সুখচর ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালরে প্রধান শিক্ষক ফজলুল হকের কাছে জানতে পারেন কাজ করে বাউবিতে লেখাপড়া করার সুযোগ রয়েছে। ভর্তি হন বাউবির এসএসসি প্রোগ্রামে। কর্মস্থলে কাজের ফাঁকে বই পড়েন। মা মেয়ে একই ক্লাশের শিক্ষার্থী হওয়ায় নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে লেখাপড়া করেন। তার ইচ্ছা আইন পড়ে দ্বীপ অঞ্চলের মানুষকে আইনি সহায়তা দেবেন।
হাতিয়ার মানুষের জীবন জীবিকার পথ অনেকটাই কঠিন। চারিদিকে সমুদ্র ও জলরাশির কারণে জেলা সদর বা নাগরিক সুবিধার জন্য জল পথ পারি দিয়ে কোথাও যেতে যেমনি অনেক কষ্ট তেমনি অনেক সময়ও লেগে যায়। বাড়িতে পরিবারের সাথে অবস্থান করে কর্মসংস্থানের সুযোগও অনেক কম। ফলে লেখাপড়া শিখে কর্মসংস্থানের পথ তৈরি এবং সমাজে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। সেজন্য রুনা লায়লা, মফিজুর রহমান, মারজান বেগম, হেলাল উদ্দিন ,শরীফ উদ্দিন, মায়মুনা ও আসমা সবাই এবছর নোয়াখালির হাতিয়া দ্বীপের সুখচর ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাউবির এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। শুক্রবার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পরীক্ষা শেষে কথা হয় তাদের সবার সাথে। তাদের মতো অনেকেই শিক্ষা লাভের জন্য বেছে নিয়েছেন বাউবিকে।
সমাজের অনেকেই নানা ভাবে বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তারা যাতে শিক্ষিত হয়ে কর্মমুখী হতে পারেন, তাদের জন্য প্রয়োজন জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষা। বাউবির মাধ্যমে সে শিক্ষা এখন বিস্তৃত হয়েছে দেশে ও বিদেশে।
দেশমাতৃকার উন্নয়নে শিক্ষায় উন্নত বাংলাদেশ সৃজন এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বাউবি কাজ করছে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে উন্মুক্ত ও দূর শিক্ষণ পদ্ধতির প্রযুক্তি বান্ধব শিক্ষাধারা। বাউবির মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ, ফিরে পেয়েছেন নিজেদের নতুন জীবন।
সবার জন্য উন্মুক্ত কর্মমুখী, গণমুখী ও জীবনব্যাপী শিক্ষা এই নবতর দীক্ষা নিয়ে বাউবি বর্তমানে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী, পিছিয়েপড়া নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে বাউবি’র শিক্ষা সেবা পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে শিক্ষার মহাসোপানে ফিরিয়ে এনে কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষতা বৃদ্ধি করে জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তর বাউবির অঙ্গীকার।
ড. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন: গবেষক ও কলামিস্ট, পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), তথ্য ও গণসংযোগ, বাউবি
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার