গাজায় নেই ঈদের আনন্দ

ফাহিমা কানিজ লাভা
১৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
গাজায় নেই ঈদের আনন্দ

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির মাধ্যমে ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হয়েছিল গত সোমবার। এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। কিন্তু এরপর আরও কদিন পেরিয়ে গেলেও কার্যকর হয়নি যুদ্ধবিরতি। কারণ ‘হামাস নির্মূল’ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অনড় ইসরায়েল। তাই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের মধ্যেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গতকালও গাজা শহরের তিনটি বাড়িতে ইসরায়েলি বোমা হামলায় অন্তত ২৮ জন নিহত ও কয়েক ডজন আহত হয়েছে। গাজার সর্ব দক্ষিণের শহর রাফার আরও পশ্চিমে ঢুকেছে ইসরায়েলি ট্যাংক। এমন শোক ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে গাজাবাসীর দুয়ারে এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা ও কোরবানির উৎসব। তবে সেই ঈদকে ঘিরে কোনো আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই তাদের মনে।

বিশে^র প্রতিটি মুসলিমের কাছে ঈদ সবচেয়ে আনন্দের দিন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ইসরায়েলের অনবরত হামলা আর প্রিয়জনদের হারানোর শোক বুকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারছে না গাজাবাসী। গত গ্রীষ্মেও গাজা উপত্যকার মুসলিমরা ঈদুল আজহার দিনটি হাসি-আনন্দে উদযাপন করেছিল। নানা পদের রান্না, পারিবার ও স্বজনদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, দরিদ্রদের মাঝে মাংস বিতরণ করা, শিশুদের জন্য নতুন পোশাক ও উপহার কেনা- সবই ছিল। কিন্তু এ বছর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আট মাসের বিধ্বংসী যুদ্ধের পর অনেক গৃহহীন পরিবারই তাঁবুতে টিনজাত খাবার খেয়ে ঈদের দিনটি কাটাবে। স্থানীয় বাজারে মাংস বা গবাদিপশু নেই বললেই চলে, শিশুদের জন্য উপহার কেনার অর্থও নেই। শুধু যুদ্ধ, ক্ষুধা এবং দুর্দশা- যেন এর কোনো শেষ নেই। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় কমপক্ষে ৩৭ হাজার ২৯৬ জন নিহত এবং ৮৫ হাজার ১৯৭ জন আহত হয়েছে।

গাজায় নিজের ঘরবাড়ি থেকে পালিয়ে দেইর আল-বালাহ শহরে আশ্রয়শিবিরের তাঁবুতে বসে যুদ্ধে নিহত মেয়ের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নাদিয়া হামুদা। তিনি বলেন, ‘এ বছর কোনো ঈদ নেই। যখন আমরা নামাজের জন্য আজান শুনি, আমরা তখন যাদের হারিয়েছি তাদের জন্য কাঁদি। আমরা ভাবি- কী থেকে কী হয়ে গেল, আমরা আগে কীভাবে জীবনযাপন করতাম!’

গাজা উপত্যকা যুদ্ধের আগেও দরিদ্র এবং বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু সেখানকার মানুষেরা তখনো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদ উদযাপন করত, পশু জবাই করত। এখন গাজার বেশিরভাগই ধ্বংসস্তূপ, অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত। গাজার অধিকাংশ কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েলি বিধিনিষেধ এবং চলমান যুদ্ধের কারণে সেখানকার মানুষ মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। অনাহারে-অর্ধাহারে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তাদের। এদিকে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৮০ হাজার ফিলিস্তিনিদের কাজের অনুমতিপত্র বন্ধ করে দিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরু আগে ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলে কাজ করত, যা ফিলিস্তিনি অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস ছিল।

গাজার বাসিন্দা নাদির আবু আরব বলেন, ‘আনন্দ করার মতো অবস্থা নেই আমাদের। এখানে প্রতিটি ঘরে শোকের মাতম। প্রতিদিন কয়েক ডজন মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের অবস্থা ১৯৪৮ সালের নাকবার চেয়েও খারাপ।’ রামাল্লায় একটি কাপড়ের দোকানের মালিক ওসামা আববুদ, তিনি বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে বিক্রি ৭০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। এমনকি ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও বেচাবিক্রি হচ্ছে না। যুদ্ধের ছায়ায় এটা আমাদের দ্বিতীয় ঈদ। যুদ্ধ, ধ্বংস, শোক এবং খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে খুব কম মানুষই ঈদের কেনাকাটা করছেন এবং নতুন পোশাক কিনছেন।’

এ সপ্তাহের শুরুতে হামাস জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু অনুরোধ জানিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে গাজার পুনর্গঠন, ইসরায়েলি অবরোধ তুলে নেওয়া, মানুষের চলাচলের অনুমতি দেওয়া এবং বিধিনিষেধ ছাড়াই পণ্য পরিবহন। হামাসের জ্যেষ্ঠ এক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেছেন, বন্দিবিনিময়ে দীর্ঘ মেয়াদে সাজা ভোগরত ১০০ ফিলিস্তিনির তালিকা দিতে চায় হামাস। যদিও ১৫ বছর বা এর চেয়ে কম সাজা ভোগরত ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে ইসরায়েল। তবে হামাসের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল বলেছে, এটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার শামিল।

এর আগে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের প্রতি আহ্বান জানায় হামাস। তবে হামাসের অবস্থানের সমালোচনা করেন ব্লিঙ্কেন। তিনি বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে হামাস যে সংশোধনী দিয়েছে, তার কয়েকটি বাস্তবায়ন করার মতো না। তবে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এসব আলোচনা চলার পরও গত বৃহস্পতিবার রাতভর রাফার পশ্চিমে আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। বাসিন্দারা বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী রাফার আরও পশ্চিমে সমুদ্র তীরবর্তী আল-মাওয়াইস এলাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। মে মাসের শুরুর দিকে রাফায় অভিযান শুরুর পর এই এলাকাকে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষণা করেছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। যদিও আল-মাওয়াইস এলাকায় হামলার কথা অস্বীকার করছে ইসরায়েল। রাফায় অভিযান শুরুর আগে সেখানে প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানের মুখে রাফা ছেড়ে তারা কিছুটা উত্তরে সরে গিয়ে মধ্য গাজার খান ইউনিস ও দেইর আল-বালাহ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল শনিবারও গাজা শহরের তিনটি বাড়িতে ইসরায়েলি বোমা হামলায় অন্তত ২৮ জন নিহত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে ঈদের আগে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার আশা দেখছেন না আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষকরা। এই ঈদ যেন গাজাবাসীদের সবকিছু হারানোর শোককেই আবার জাগিয়ে তুলবে!