বাজেট অনেকটাই বাস্তবানুগ তবে আরও ন্যায়ানুগ করা যেত

ড. আতিউর রহমান
০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাজেট অনেকটাই বাস্তবানুগ তবে আরও ন্যায়ানুগ করা যেত

আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটিকে ঢালাওভাবে গতানুগতিক বলা ঠিক হবে না। চ্যালেঞ্জিং এই সময়ে যথেষ্ট কৌশলের সঙ্গেই এবারের বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। তাই আগের চেয়ে আলাদাভাবেই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। আমরা আরও আগে থেকেই বলে আসছি যে বাইরের এবং ভেতরের নানামুখী চাপে আছে আমাদের অর্থনীতি। কারণ একদিকে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা, অন্যদিকে আমাদের নিজস্ব সামষ্টিক অর্থনীতিও চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বড় রকমের অনিশ্চয়তা দানা বেঁধেছে অর্থনীতিকে ঘিরে। তা ছাড়া নতুন সরকারেরও এটি প্রথম বাজেট। কাজেই এই বহুমুখী চাপের মুখে প্রণীত বাজেট প্রস্তাবটিকে একটি বিশেষ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে। সে বিচারে একেবারে শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার যে, এই প্রস্তাবিত বাজেটটি প্রাথমিকভাবে দেখে একে বাস্তবতার প্রতি অনেকটাই সংবেদনশীলই মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে এই বাজেটটিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরেকটু

কল্যাণমুখী হওয়ার সুযোগ যে ছিল সে কথাটিও বলতে চাই। বাজেটটি সদ্যই সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্য অংশীজনরা আরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন। মহান জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনেও এখানকার প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে আরও আলোচনা হবে। তখন আরও গভীরতর পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাওয়া যাবে। আপাতত প্রথম নজরে বাজেট প্রস্তাবনার যে দিকগুলো স্পষ্ট হয়েছে তা তুলে ধরা যায়।

আগের থেকেই সবাই ধারণা করছিলেন যে, এবারের বাজেটটি সাম্প্রতিক ধারার তুলনায় কিছুটা সঙ্কোচনমুখীই হবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতি নিয়ে এগোচ্ছে। ফলে রাজস্ব নীতিতেও সঙ্কোচনমুখিতাই কাম্য। ২০১৯-২০-এ আমাদের প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪-এ এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশিতে। অর্থাৎ এ সময়কালে গড়ে বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭.৬ শতাংশ হারে। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও চলতি বছরের প্রস্তাবিতর চেয়ে বাজেট বেড়েছে। তবে আগের হারে বাড়েনি। মাত্র ৪.৬ শতাংশ বেড়ে ৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা হয়েছে। ফলে বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল বাজেট-প্রণেতারা সঙ্কোচনের পথেই এগোতে চাইছেনÑ তা দৃশ্যমান।

এবারের বাজেটে বাস্তবতার নিরিখে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপিতে বেশি বেশি প্রকল্প বাবদ ব্যয় বরাদ্দ না রাখার পরামর্শ ছিল। সাম্প্রতিক পাঁচটি অর্থবছরে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ করে এডিপির আকার বেড়েছে। কিন্তু নতুন অর্থবছরের এডিপিতে চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিতর চেয়ে বরাদ্দ মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রস্তাবিতর চেয়ে আসছে বছরের এডিপি বরাদ্দ বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম। কাজেই নতুন নতুন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় আসছে বছরের জন্য সরকার যথেষ্ট সংযমী হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে। মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে রাজস্বনীতিকে সংযত রাখার অংশ হিসেবে বাজেট ঘাটতি ৪.৫ শতাংশ রাখার আকাক্সক্ষাটিও বাস্তবতার নিরিখে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলা চলে। এই অবস্থায় আশা করা গিয়েছিল সামনের বছর প্রবৃদ্ধির ওপর আরও কম জোর দেওয়া হবে। কেননা সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশ আশা করা বেশ খানিকটা উচ্চাভিলাষীই বলা চলে। একই কথা বলা যায় মূল্যস্ফীতির প্রস্তাবিত হারের বেলাতেও। প্রায় দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি রয়ে গেছে। গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দশ শতাংশের বেশি এবং সার্বিক মূল্যস্ফীতিও প্রায় দশ শতাংশের কাছাকাছি। এই বাস্তবতায় এই হার সাড়ে তিন শতাংশের মতো কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা মোটেও সহজ হবে না। সেজন্য বাজেট ঘাটতি আরও কমিয়ে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের পরিমাণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। এই তিন সূচকেই বাজেটকে আরও বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। আমাদের অর্থনীতির এ তিনটি ক্ষেত্রেই সক্ষমতার যে ঘাটতি আছে তা মেনে নিতে হবে। সংকটকালে এই আত্ম-উপলব্ধির গুরুত্ব অনেক। সমস্যার পেছনের উৎসগুলোর সঠিক সন্ধান করে চিহ্নিত করাও যে নীতি-বিচক্ষণতার অংশ সে কথাটি আমাদের মানতে হবে।

নিশ্চয় আমরা সার্বিকভাবে বাজেটে সঙ্কোচনমুখিতার পক্ষে। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতে বরাদ্দ, কৃষির জন্য বরাদ্দ, এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে সহায়ক খাতে/কর্মসূচিতে/প্রকল্পে বরাদ্দে এই কাটছাঁটের প্রভাব যতটা সম্ভব কম ফেলা যায় ততই কল্যাণকর বলে মনে করি। মোট বরাদ্দের কত অংশ কোন খাতে গেছে সেদিকে মনোযোগ দিলে দেখা যাচ্ছে যে আসছে বছরে সাম্প্রতিক অর্থবছরগুলোর মতোই মোট বরাদ্দকে বিভিন্ন খাতের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। ফলে বলা চলে কাটছাঁটের প্রভাব সব খাতেই সমানভাবে পড়েছে। এ কারণেই আমরা মনে করছি বাজেটটি বাস্তবানুগ হলেও এটিকে আরেকটু কল্যাণমুখী করার কথা ভাবা যেত। আরেকটু ন্যায়ানুগ করার সুযোগ নিশ্চয় ছিল।

প্রথমে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের কথা ধরা যাক। অন্যান্য বছরের মতো আসছে অর্থবছরের বাজেটেও এ খাতের জন্য মোট বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশের একটি অনুপাত বরাদ্দ রাখা হয়েছে (মোট বাজেটের ৫.২ শতাংশ)। আমরা দীর্ঘকাল ধরে এই অনুপাতটি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলে আসছি। এবার অর্থনৈতিক চাপ থাকলেও এ অনুপাতটি বাড়ানো গেলে খুব ভালো হতো। মনে রাখতে হবে যে, দেশে মোট যে স্বাস্থ্য ব্যয় হয় তার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি জনগণকে নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়। সরকারের দেওয়া বাজেট দিয়ে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ২৩ শতাংশের মতো নির্বাহ হয়। তাই মূল্যস্ফীতির কালে সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্য বাবদ বরাদ্দ বাড়ানো গেলে দরিদ্র নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কিছুটা কমানো সম্ভব হতো।

শিক্ষা ও প্রযুক্তিতেও বরাবরের মতো বাজেটের সর্বোচ্চ অংশ (১৪ শতাংশের মতো) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে প্রযুক্তি বাদ দিলে কেবল শিক্ষার দুটি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকে বিবেচনায় নিলে এই অনুপাত কমে ১২ শতাংশের নিচে চলে আসে। প্রতিবারই এমন হয়। কিন্তু এবারে যেহেতু বাজেটের আকার আগের মতো হারে বাড়েনি, তার অর্থ দাঁড়ায় যে শিক্ষার বরাদ্দও আগের মতো হারে বাড়েনি। কিন্তু বিরাজমান বাস্তবতায় আমাদের বিনিয়োগকে বলশালী করতে এবং প্রবাসী আয় বাড়াতে জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিশেষ মনোযোগ দরকার। জনশক্তি প্রশিক্ষণের ওপর আরেকটু জোর দিলে ভালো হতো। আর সে জন্য শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে মনোনিবেশ করা জরুরি। বাড়তি বরাদ্দ মানেই অবকাঠামো উন্নয়নের বরাদ্দ ভাবলে চলবে না। অবকাঠামো বাবদ বাড়তি বরাদ্দ দিলে সেটি ব্যয় করার সক্ষমতার বিষয়টি আসে। কিন্তু যোগ্য শিক্ষকের অভাব আমাদের রয়েছে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের বেতন-ভাতা বাবদ বাড়তি বরাদ্দ দিলে সেটি তো আর অব্যয়িত থাকার কথা নয়।

রাজস্ব আদায়ের জন্য বাড়তি চাপে থাকায় বাজেটে ব্যাপক হারে করের বোঝা চাপানো হবে- এমন আশঙ্কা অনেকে করেছিলেন। তবে বাজেট-প্রণেতারা শেষ পর্যন্ত সে পথে যাননি বলেই মনে হয়েছে। বরং অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ‘কর ন্যায্যতা বৃদ্ধি’র জন্য দান/অনুদান করমুক্ত ও এতিমখানার গাড়িকে কর অব্যাহতি প্রদানের মতো কিছু শুভ উদ্যোগের কথা বলেছেন। তবে মূল্যস্ফীতির এই দুঃসময়ে বৈধ পথে সর্বোচ্চ ধাপের আয়ে তিরিশ শতাংশ করারোপের বিপরীতে কালোটাকার ওপর তার অর্ধেক তথা পনেরো শতাংশ করারোপের প্রস্তাবটি নৈতিকতার বিচারে কতটা সঠিক সে বিষয়ে যে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন। একই বিচারে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট বেশির ভাগ মানষের আয় বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত না রেখে আরেকটু বাড়ানোর কথা ভাবা যায়। এখনো সে সুযোগ আছে। মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর যে কর আরোপের কথা বলা হচ্ছে সেটিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

মোট রাজস্ব আদায়ের যে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটিকেও সময়োচিত মনে হচ্ছে। তবে এই কর আদায় করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি বছরে যে ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধিত বাজেটে দেখা যাচ্ছে আদায় হয়েছে মাত্র ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আসছে বছরে কর আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে প্রথমত রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা উন্নয়ন ও ডিজিটাইজেশনে মনোনিবেশ করতে হবে। পাশাপাশি যারা কর দিচ্ছেন তাদের ওপর বেশি বেশি করের বোঝা না চাপিয়ে নতুন নতুন করাদাতাকে কর প্রদানে আগ্রহী করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। অবশ্যি বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী করের জাল সম্প্রসারণের দিকে নজর দেবেন বলে বলেছেন। বিদেশি বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য করনীতিকে পাঁচ থেকে দশ বছরের মতো স্থিতিশীল রাখা, সরাসরি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের লভ্যাংশ ও পুঁজি সহজেই স্থানান্তর করা এবং স্থিতিশীল বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বাজেটে আরও স্পষ্ট উচ্চারণ আশা করেছিলেন অনেকেই। আশা করছি বাজেট পর্যালোচনায় এসব বিষয়ের ওপর সংসদ সদস্যগণ ও বিশেষজ্ঞমহল যথেষ্ট আলো ফেলবেন। আর নীতিনির্ধারকরা এসব পরামর্শের আলোকে প্রস্তাবিত বাজেটটি সংশোধন করে তাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে চূড়ান্তভাবে পাস করবেন।

সব মিলিয়ে প্রাথমিক বিচারে এবারের বাজেটটিকে অনেকটাই বাস্তবমুখী ও সময়োচিত হিসেবেই দেখতে হবে। তবে যেহেতু অনেকখানি কাটছাঁট করতে হয়েছে, তাই এই সঙ্কুচিত বাজেট বাস্তবায়নে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে। নীতি-নির্ধারকদের পাশাপাশি মাঠ-পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তৎপরতা দেখাতে হবে।

ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।