ওষুধ বিপণনে স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি

ডা. মো. ছায়েদুল হক
০৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ওষুধ বিপণনে স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি

কদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম কীভাবে লিপিবদ্ধ করা উচিত এ নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। বর্তমানে আমাদের দেশে চিকিৎসকগণ তাদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ কোম্পানি যে নামে ওষুধটি বাজারজাত করে থাকে সে নামেই লিপিবদ্ধ করে থাকেন। এটিকে বলা হয় ব্র্যান্ড নাম। ওষুধের আসল নামকে বলা হয় জেনেরিক নাম। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন প্যারাসিটামল হলো একটি ব্যথানাশক ওষুধের নাম। কোম্পানি যখন এটি বাজারজাত করে তখন কোনো কোম্পানি এটির নাম দেয় নাপা আবার কোনো কোম্পানি এটির নাম দেয় এইস। এখানে প্যারাসিটামল হলো জেনেরিক নাম এবং নাপা বা এইস হলো ব্র্যান্ড। চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম বা ব্র্যান্ড যাই লিখুক তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথচ এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। বিতর্কের কোনো সারবত্তা আছে কী নেই মন্তব্যের আগে কিছুটা আলোকপাত করলে বিতর্কের গভীরে যাওয়া সহজ হবে।

একজন চিকিৎসক একটি ওষুধ প্রেসক্রাইভ করবেন তার রোগীর জন্য। উদ্দেশ্য রোগ নিরাময়। ওষুধটি অবশ্যই মানসম্পন্ন এবং রোগীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে হতে হবে। কোম্পানি ওষুধটি বাজারজাত করার সময় গবেষণা ব্যয়, প্রোডাকশন খরচ ও বিতরণ খরচের সঙ্গে মুনাফা যোগ করে তবে বাজারমূল্য নির্ধারণ করে থাকে। যখন একটি কোম্পানি তার নিজস্ব গবেষণালব্ধ ওষুধটি বাজারজাত করেন তখন এর সম্পূর্ণ মালিকানা তার একান্তই নিজস্ব। এটি হলো পেটেন্ট এবং যে নামে ওষুধটি বাজারজাত করা হয়েছে সেটি হলো কোম্পানির ব্র্যান্ড। প্রতিটি পেটেন্টের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে মূল কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ নিজ থেকে এই ওষুধটি প্রস্তুত বা বিপণন করতে পারবে না। প্রস্তুত করতে বা বিপণন করতে চাইলে পেটেন্ট ক্রয় করতে হবে অর্থাৎ অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে মূল কোম্পানির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে শর্তসাপেক্ষে উক্ত ওষুধটি প্রস্তুত ও বিপণন করতে পারবে। তবে পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হলে মূল কোম্পানির অনুমতি ছাড়াই যে কোনো ওষুধ কোম্পানি কোনো ধরনের মূল্য পরিশোধ বা রয়ালটি ছাড়াই ওষুধটি প্রস্তুত ও বিপণন করতে পারবে। এটিই জেনেরিক মেডিসিন। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো এটি বায়ো ইকুবেলেন্ট হতে হবে। প্রতিটি ওষুধ দুই ধরনের উপাদানের সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয়। একটি হলো সক্রিয় উপাদান (অপঃরাব চযধৎসধপবঁঃরপধষ ওহমৎবফরবহঃ ড়ৎ অচও) যেটি আসল উপাদান যা রোগ নিরাময় করে। ওষুধ কোম্পানির ভাষায় এটিকে বলা হয় এপিআই। দ্বিতীয়টি হলো নিষ্ক্রিয় উপাদান (রহধপঃরাব রহমৎবফরবহঃ)। নিষ্ক্রিয় উপাদানের প্রধান কাজ হলো এপিআইয়ের বাহন হিসেবে কাজ করা এবং এর গুণাবলি দীর্ঘদিন অটুট রাখতে সাহায্য করা। এছাড়াও এটি যাতে সহজে সেবন করা যায় বা সহজে হজম হয় তা নিশ্চিত করার জন্য অতিরিক্ত বস্তুর সংমিশ্রণ করা হয়ে থাকে। ফ্লেবারিং এজেন্ট, প্রিজার্বেটিভ, ক্যাপসুলের কভার বা শেল এসবই নিষ্ক্রিয় উপাদানের অংশ। জেনেরিক ওষুধে কোনো কোম্পানি এপিআই শতভাগ দিতে বাধ্য হলেও আনুষঙ্গিক বস্তু, প্রিজার্বেটিভ, ফ্লেবারিং এজেন্ট ইত্যাদির ব্যাপারে কিছুটা স্বাধীনতা থাকে। ফলে কার্যকারিতা এক হলেও ব্র্যান্ড ওষুধ এবং জেনেরিক ওষুধে কিছুটা ভিন্নতা থাকে।

জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রে যেহেতু তার গবেষণা খরচ নেই, পেটেন্ট ক্রয় বাবদ খরচ নেই তদুপরি এপিআই বাদে বাকি উপাদানে কম্প্রোমাইজ করার সুযোগ থাকে, ফলে ওষুধটির বাজারমূল্য ব্র্যান্ড প্রোডাক্টের চেয়ে অনেকটাই কমে আসবে। ফলে জেনেরিক ওষুধ সব সময় সাশ্রয়ী। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে কম খরচে ওষুধ পেতে পারে তার জন্য এটি একটি সুযোগ। এক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের দেশ বা এলডিসিভুক্ত দেশগুলো ব্যতিক্রম। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোকে একটি বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ব্র্যান্ড তারা চাইলে পেটেন্ট না কিনেই ব্র্যান্ড আইটেম প্রস্তুত ও বিপণন করতে পারবে। এর জন্য পেটেন্ট কোম্পানিকে কোনো ধরনের রয়ালটি দিতে হবে না। আমাদের দেশ এখনও এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশভুক্ত বিধায় এই সুযোগটি ভোগ করে সব ধরনের ব্র্যান্ড ওষুধ প্রস্তুত করে আসছে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিগণিত হলে এ সুবিধা থাকবে না। ফলে এখানে প্রতিটি ওষুধ ব্র্যান্ড নামে থাকলেও মূল্য জেনেরিকের মতোই। বাংলাদেশে রোগী ব্র্যান্ড নামে ক্রয় করলেও জেনেরিকের সুবিধা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হলে তখন এই সুবিধা থাকবে না। জেনেরিক নাম প্রেসক্রিপশনে লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি কেন সামনে এলো?

কেউ কেউ মনে করেন ব্র্যান্ড নাম ব্যবহারের কারণে দেশে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ব্র্যান্ডকে জনপ্রিয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। এতে মুনাফার একটি বড় অংশ প্রোমোশনে ব্যয় করে ওষুধ বিপণনে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন প্রোমোশন করতে গিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরেও তারা চিকিৎসককে উপঢৌকন, ব্যক্তিগত উৎকোচ প্রদানের মতো গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ছেন। কোনো কোনো চিকিৎসক ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার বিনিময়ে কোম্পানির কোনো কোনো প্রোডাক্ট বা মেডিসিনকে প্রোমোট করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। হয়তো কিছুটা ভিত্তিও আছে। ফলে প্রোমোশন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রোমোশন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ওষুধের দামও বেড়ে যাচ্ছে। মূলত এখান থেকেই বিতর্কের শুরু।

দেশে বর্তমানে ওষুধের বাজারমূল্য প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি টাকা এবং প্রোমোশন ব্যয় প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। বিষয়টি খুবই বিপজ্জনক। কারণ ২৫ শতাংশ প্রোমোশনে খরচ মানে এখানে প্রচুর বাহুল্য খরচ বিদ্যমান এবং এই খরচটি আসলে ওষুধের দামের সঙ্গে যুক্ত হবে। অর্থাৎ এই টাকাটা দিন শেষে রোগীর কাছ থেকে আদায় করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না ওষুধের বাজার নির্ধারণে অন্যতম নিয়ামক হচ্ছেন চিকিৎসক। এখন চিকিৎসকগণ যদি কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ করেন তবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। অনেকের ধারণা জেনেরিক প্রেসক্রিপশনে না লিখলে এই যোগসাজশের বিষয়টি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তখন এই যোগসাজশের বিষয়টি চলে যাবে ফার্মেসিতে। আমাদের প্রতিটি ওষুধের গায়ে ব্র্যান্ড নামের পাশাপাশি জেনেরিক নাম উল্লেখ থাকে। এমতাবস্থায় প্রেসক্রিপশনে কেবলই জেনেরিক নাম উল্লেখ করলে রোগী যখন ফার্মেসিতে যাবে তখন ফার্মেসি ঠিক করে দেবে কোন ব্র্যান্ড রোগীকে দেবে। যোগসাজশের সূতিকাগার হলো স্পন্সরশিপ। স্পন্সরশিপের বিষয়টি বৈশ্বিকভাবে একটি স্বীকৃত বিষয়। কোনো বৈজ্ঞানিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গবেষণা, চ্যারিটি ইত্যাদি খাতে স্পন্সর করতে দোষের কিছু নেই। তবে ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য স্পন্সরশিপ অনৈতিক। ইদানীং অভিযোগ উঠেছে, অনেক চিকিৎসক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য আর্থিক অনুদান গ্রহণ করে থাকেন। অনেকটা চুক্তিবদ্ধ হওয়ার মতো। বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়।

বর্তমানে দেশে প্রচুর সোসাইটি এবং তার শাখা-প্রশাখা মিলে শত শত পেশাজীবী সংগঠন। সোসাইটিগুলোর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, বিভিন্ন ধরনের ডে বা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ইত্যাদি আয়োজন করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পনিগুলোকে স্পন্সর করতে হয়। এসব অধিবেশনে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় খরচের চেয়ে বাহুল্য খরচ অনেক বেশি। অনেক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে যোগদানের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি সেখানে রেজিস্ট্রেশনের সময় একদম স্বল্প মূল্যের হালকা ছোট একটি কাপড়ের অথবা চট জাতীয় ব্যাগ দেওয়া হয় কাগজপত্র এবং বুকলেট ইত্যাদি বহন করার জন্য। আর আমাদের দেশে একটি জাতীয় সম্মেলন যেটি পেরেন্ট বডি নয় অর্থাৎ অঙ্গ সংগঠন যার রেজিস্ট্রেশন কিট একটি ট্র্যাভেল ব্যাগ।

এখান থেকে বের হয়ে আসার উপায় কী? সবার স্বার্থে চিকিৎসক এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোকে এখান থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। প্রথমেই ওষুধ বিপণন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ওষুধের সব দোকান বা ফার্মেসিকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে এবং ফার্মেসির সংখ্যা সীমিত করতে হবে যাতে প্রতিটি ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করা যায়। নিবন্ধনহীন কেউ যেন প্রেসক্রিপশন বা ওষুধ বিক্রি করতে না পারে তার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারের ওষুধের বায়ো ইকুবেলেন্ট নিশ্চিতে ওষুধ প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। স্পন্সরশিপ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। বাহুল্য খরচ স্পন্সরশিপের আওতাবহির্ভূত করতে হবে। এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের সমিতিগুলোকে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ওষুধ কোম্পানির প্রোমোশন বাজেট সীমিত করতে হবে এবং এটিকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে। শেষ কথা হলো Ñ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বিদ্যমান রেখে কোনো আয়োজনই সফলতার মুখ দেখে না, এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।


ডা. মো. ছায়েদুল হক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক