মাতৃমৃত্যু হার কমাতে প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করতে হবে
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মা ও শিশুমৃত্যু হার কমানোর কৌশলপত্রের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে প্রতি লাখ সন্তান প্রসবে মাতৃমৃত্যু হার ছিল ২৫৯ জন। সম্প্রতি সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬৫ জনে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু প্রতি হাজারে ৫০ জনের নিচে নামিয়ে আনা। বর্তমানে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ১৫৩। অর্থাৎ এক লাখ জীবিত সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ১৫৩ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। মাতৃমৃত্যু হার কমাতে হলে বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে এবং অবশ্যই সন্তান প্রসবের সময় ঘরে ডেলিভারি না করিয়ে হাসপাতালে ডেলিভারি করালে মৃত্যুহার কমে আসে।
মাতৃমৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণ হচ্ছে : ১. রক্তক্ষরণ (চচঐ) ২. প্রি-একলামশিয়া। ৩. উচ্চরক্তচাপ। ৪. প্রসবের জটিলতা এবং ৫. অনিরাপদ গর্ভপাত।
মাতৃমৃত্যুর ৩০ শতাংশই হয় প্রসব-উত্তর রক্তক্ষরণ। ২৪ শতাংশ হয় গর্ভাবস্থায় উচ্চরক্তচাপ, বাকিগুলো গর্ভকালীন সংক্রমণ ও বিভিন্ন ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে। মাতৃমৃত্যু হার কমাতে বাড়িতে প্রসবের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে অনিরাপদ গর্ভপাত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে গর্ভপাত যেখানে-সেখানে করিয়ে ইনফেকশন হয়ে অকালেই মারা যায়। অনিরাপদ এমআর থেকে বিরত থাকতে হবে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’
মা যদি সুস্থ থাকেন তা হলে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন। সুস্থ সন্তান আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, আমাদের দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যে সুস্থ একটি জাতি উপহার দেবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নেতৃত্ব দেবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। তার জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। মা যখন গর্ভে সন্তান ধারণ করেন তখন তার প্রয়োজন চেকআপ করানো। সেটি অবশ্যই হাসপাতালে করাতে হবে এবং ডেলিভারি হাসপাতালে করাতে হবে। গর্ভবতী নারী মিনিমাম চারবার প্রসব-পূর্ব সেবা গ্রহণ করার জন্য হাসপাতালে চেকআপে থাকতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে। গর্ভবতী অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। সবাই সচেতন হোন। নিজে ভালো থাকুন, দেশকে ভালো রাখুন। বাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ প্রসব, বাল্যবিবাহ এবং কিশোরীদের গর্ভধারণের হার বেড়ে গেলে মাতৃমৃত্যু বেড়ে যাবে। তাই এগুলো রোধ করতে হবে। প্রসব-পূর্ব সেবা, প্রসব-পরবর্তী সেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা একসঙ্গে সমন্বিতভাবে করতে হবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয়কে নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী, একজন নারী গর্ভাবস্থায়, প্রসবাবস্থায় কিংবা প্রসবোত্তর ৪২ দিনের মধ্যে শারীরিক জটিলতার কারণে মারা গেলে তাকে মাতৃমৃত্যু বলা হবে। একটু সচেতন হলেই মাতৃমৃত্যু একদম কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
নারী যদি গর্ভাবস্থা ও প্রসবাবস্থায় সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান, সেবা ঠিকমতো নিতে পারেন, তা হলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক কমে আসবে। মূলত খিঁচুনি ও প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই বেশির ভাগ নারীর মৃত্যু ঘটে। তাই গর্ভকালে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নারীকে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে অবশ্যই সহায়তা করতে হবে। একজন নারী যখন গর্ভবতী থাকেন তখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পরিবারের দায়িত্ব এবং একটি সুস্থ সুন্দর পরিবেশ উপহার দেওয়া সমাজের দায়িত্ব। অনেকে ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যান না। গর্ভবতী নারীর সেবায় প্রতিটি স্তরে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। গর্ভাবস্থায় চেকআপের জন্য চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। মায়েদের এ বিষয়ে বিশেষ করে পরিবারের লোকজনকে ভূমিকা নিয়ে কাজ করতে হবে, সচেতন হতে হবে। সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে সবাইকে।
ঘরের কাজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারীরা নিজেদের নিয়ে কম ভাবেন তাই নিজের খেয়াল যেমন রাখতে হবে, তেমন করে পুরুষদের দায়িত্ব নিয়ে নারীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মাতৃমৃত্যু রোধে সব থেকে জরুরি নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করা। মাতৃমৃত্যু হার কমাতে জরুরি প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা চালু আছে। সবাই সহজেই এই সেবা নিতে পারেন। বিভাগীয় শহরগুলোতেও আছে। জেলা-উপজেলাগুলোতে কার্যক্রম চালু আছে অনেক আগে থেকেই। গর্ভাবস্থায় প্রসবকালীন যত্ন, শিশুর জন্মের সময় যত্ন এবং সন্তানের জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যত্ন ও সহায়তা মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ডা. আয়শা আক্তার : উপপরিচালক, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল, শ্যামলী, ঢাকা