বর্তমানরাও কিন্তু এক সময় সাবেক হবেন

প্রভাষ আমিন
০৪ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বর্তমানরাও কিন্তু এক সময় সাবেক হবেন

এখন যারা সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন, সংসদে আছেন বা মন্ত্রিসভায় আছেন; তাদের দাপটে টেকা দায়। কিন্তু তাদের দিকে তাকালে আমার এক ধরনের মায়া হয়। মনে হয়, তাদের এই দাপট, এই ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। সমস্যা হলো দায়িত্ব বা ক্ষমতা যে ক্ষণস্থায়ী, এটাই তারা বোঝেন না। বিসিএস দিয়ে যিনি সহকারী সচিব হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন, তিনি সর্বোচ্চ সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসরে যেতে পারেন। এর মাঝে সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব হতে পারেন। ইউএনও, জেলা প্রশাসক বা বিভাগীয় প্রশাসকের মতো দায়িত্বও পালন করতে পারেন। ইউএনও বা জেলা প্রশাসক তো উপজেলা বা জেলার সর্বেসর্বা। পুরো চাকরি জীবনটাই তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন। মানুষকে মানুষ মনে করেন। পদের সঙ্গে প্রশাসক থাকলেও কার্যত তারা সরকারের চাকর, জনগণের সেবক। কিন্তু আমাদের আমলাতন্ত্রের মূল সমস্যা হলো, তারা সযত্নে নিজেদের জনগণ থেকে দূরে রাখেন। সাধারণ মানুষকে তারা যতটা দৌড়ের ওপর রাখতে পারবেন, যতটা ভয় দেখাতে পারবেন; ততই যেন সফল প্রশাসক তিনি। কিন্তু দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে একজন সিনিয়র সচিব যখন অবসরে যান, মুহূর্তেই বদলে যায় তার চারপাশ। তিনিও নেমে আসেন আমজনতার কাতারে। আগের দিনের যুগ্মসচিব, পরের দিন পেনশনের টাকা তুলতে গেলে অবহেলায় বসে থাকতে হয়। আগের দিনের দাপট পরের দিনের অসহায়ত্ব দেখে আমার আসলেই মায়া হয়। আগের দিন যার গাড়ির সামনে-পেছনে প্রটোকল, পুলিশের সাইরেনে রাস্তা পরিষ্কার, বাসা-অফিসে যার কাজ করার জন্য চাকর-বাকর-নওকররা এক পায়ে খাড়া; পরদিন রাস্তায় হাঁটলেও কেউ তাকে চেনে না। অথবা চিনলেও ঘৃণা করে।

প্রশাসন ক্যাডারের একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। আমলাতন্ত্রের পরতে পরতে, বিভিন্ন বাহিনীতে, রাজনীতিতে, খেলাধুলা, বিনোদনÑ সর্বত্র ক্ষমতা-পূর্ববর্তী আর ক্ষমতা-পরবর্তীÑ এই দুটি ধাপ থাকে। চতুর সামরিক-বেসামরিক আমলারা ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চাকরি শেষেই রাজনীতিতে নেমে পড়েন। রাজনীতির ধাপে ধাপে এমপি বা মন্ত্রী বনতে পারলে আরও অনেকদিন থাকা যায় ক্ষমতার উত্তাপের কেন্দ্রে। ইদানীং খেলোয়াড় বা বিনোদনের তারকারাও রাজনীতিতে নেমে পড়ছেন। তারা বুঝে যান খেলা বা বিনোদনের গ্ল্যামারটা এক সময় ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু রাজনীতির গ্ল্যামার আরও অনেকদিন তাদের লাইমলাইটে রাখবে। তবে রাজনীতিও কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। একবার ভাবুন, বিএনপি-জামায়াতের ২০০১-০৬ পর্যন্ত শাসনামলে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান বনানীর হাওয়া ভবনে বসে দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছেন। যদিও সরকারে তার কোনো পদ ছিল না। সেই তারেক রহমানকে এখন একাধিক মামলায় দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বেগম খালেদা জিয়া সরকারের অনুকম্পায় গুলশানের বাসায় থাকতে পারছেন। তখনকার দাপুটে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন। জেল দেওয়া চুলে স্পাইক করা আর কথায় কথায় ভুলভাল ইংরেজি বলা লুৎফুজ্জামান বাবরকে মাঝে মাঝে কারাগার থেকে আদালতে আনলে তার এখনকার চেহারা দেখে যে কারও খারাপ লাগবে। তবে মানতেই হবে, এটা তারই পাপের ফল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা কোনো ব্যক্তি যদি বিরোধীদলীয় নেতাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্রের অংশীদার হন, তার তো এই পরিণতিই হওয়ার কথা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১/১১-এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। ১/১১ কুশীলবদের ভয়ে তখন সত্যি সত্যি বাঘে-মোষে এক ঘাটে জল খেয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির দাপুটে সব নেতা কারাগারে একসঙ্গে বসে খেয়েছেন, লুডু খেলেছেন। ১/১১-এর সেই মহাপরাক্রমশালী কুশীলবরা এখন দেশেই আসতে পারেন না। অতদূর যাওয়ার দরকার নেই। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক সাবেক মন্ত্রী এখন লাপাত্তা। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের দাপটে এক সময় সবাই কাঁপত। মন্ত্রিত্ব তো গেছেই, পতন ঘটেছে ফরিদপুরে তার বিশাল সাম্রাজ্যেরও। এখন তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন; কেউ জানে না। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হয়তো দেশে নেই। কিন্তু সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাবেক আমলা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর হয়তো দেশেই আছেন। তিনি কেমন আছেন, কেউ কি জানেন? অথচ এক সময় আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিÑ দুই ক্ষেত্রেই মখা আলমগীরের দাপটে ছিল প্রবল। শুধু মন্ত্রী-এমপি কেন, ক্ষমতার সূর্যের আলো না পেলে অনেক চাঁদেই গ্রহণ লাগে। যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে সবাই ‘স্যার’ ডাকতেন, পা ছুঁয়ে সালাম করতেন। পদ হারানোর পর কেউ আর তার খোঁজও রাখেন না। ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শোভন-রাব্বানীও পদ হারানোর পর রাজনীতিতে অপাঙক্তেয় হয়ে গেছেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী, এমপি হেরেছেন। তার পর থেকে কেউ আর তাদের খোঁজ রাখছেন না। সাবেক পুলিশপ্রধান ও সাবেক সেনাপ্রধান তো এখন সারাদেশের মানুষের চর্চার বিষয়। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, তারেক রহমানের সঙ্গে তাদের একজনের ছবি এখন ভাইরাল। অথচ ছবিটি ১৭-১৮ বছর আগে তোলা। এতদিন যেন কেউ ছবিটি দেখেইনি।

ক্ষমতার এই উত্থান-পতনের কথা ভেবেই বুঝি কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গিয়েছিলেন, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়; আজিকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়।’ আসলে আমরা যখন কোনো দায়িত্ব পাই, সেটাকে চিরস্থায়ী মনে করি। ভাবি, এই ক্ষমতা কখনো যাবে না। আরেকটা সমস্যা হলো, আমরা দায়িত্বকে ক্ষমতা মনে করে ভুল করি। জনগণ ভোট দিয়ে এমপি বানায় সংসদে তাদের হয়ে কথা বলার জন্য, বিপদের দিনে তাদের পাশে থাকার জন্য। কিন্তু নির্বাচনের পরই অধিকাংশ এমপি জনগণকে ভুলে যান। গোটা নির্বাচনী এলাকাকে নিজের সাম্রাজ্য মনে করেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বালুমহাল, বাসস্ট্যান্ড, টেম্পোস্ট্যান্ডে চাঁদা তোলাÑ সব তাদের দখলে থাকা চাই। বিভিন্ন ক্যাডারের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বই হলো দেশ পরিচালনায় সরকারকে সহায়তা করা। কিন্তু আমরা সেবকের বদলে প্রভু বনে যাই। নিজেদের অবস্থানের সঠিক মূল্যায়নটা আমরা করতে পারি না।

ক্ষমতা বা দায়িত্বে থাকার সময় যদি আমরা জনগণের সঙ্গে থাকি, তাদের জন্য কাজ করি; ক্ষমতা হারালেও তাদের ভালোবাসা পাওয়া অসম্ভব নয়। মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, এখন নেই। কিন্তু তার জীবনযাপনে কোনো পরিবর্তন নেই। মন্ত্রী থাকার সময়ও তাকে কারওয়ানবাজারের ফুটপাত থেকে দরদাম করে সবজি কিনতে দেখেছি। ক্ষমতার যতই পালাবদল ঘটুক, মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে কেউ, কখনো কোনো মামলা দিতে পারবে না। তারেক রহমান বা লুৎফুজ্জামান বাবর যদি গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা না করতেন; তা হলে তো তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতো না। তাদেরও পালিয়ে বা কারাগারে থাকতে হতো না। বিএনপি সরকারের সব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে তো বাবরের মতো মামলা নেই।

আমরা যদি ভাবি, ৫ বছর, ১০ বছর পর আমার ক্ষমতা চলে যেতে পারে, ২০ বছর পর আমাকে অবসর নিতে হবে; তা হলে হয়তো আজকের অবস্থানের ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকব। বর্তমানদের মাথায় যদি থাকে, তাকেও একদিন সাবেক হতে হবে, তা হলে হয়তো তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না, দুর্নীতি করবেন না। তা হলেই সাবেক হলেও তাকে অসহায় হতে হবে না, জনগণের ঘৃণা কুড়াতে হবে না।


প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান এটিএন নিউজ