ঢাকার গ্যারেজগুলোতে বিদ্যুৎ চুরির হিড়িক

ইউসুফ সোহেল
০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ঢাকার গ্যারেজগুলোতে বিদ্যুৎ চুরির হিড়িক

সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও ঢাকার দুই সিটিতে (উত্তর-দক্ষিণ) এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৮ থেকে ১০ লাখ অটোরিকশা; সঙ্গে রয়েছে আরও প্রায় দুই লাখ ইজিবাইক। অবৈধ এসব বাহনের ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নগরীর অলিগলিতে একের পর এক গ্যারেজ গড়ে তোলা হয়েছে। অটোরিকশা চার্জের নামে এসব গ্যারেজে বিদ্যুৎ চুরির হিড়িক পড়েছে।

অভিযোগ আছে, দিনে বৈধ বিদ্যুতের লাইন দিয়ে ব্যাটারি চার্জ দিলেও রাত গভীর হলে হুকিং সিস্টেমে সরাসরি খাম্বা থেকে অবৈধভাবে লাইন টেনে বিদ্যুৎ চুরি করেন গ্যারেজ মালিকরা। অনেকে আবার আবাসিক মিটার থেকে লাইন টেনে গোপনে চার্জ দিচ্ছেন। গ্যারেজ মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিতে মাসিক কিংবা সাপ্তাহিক মাসোয়ারার বিনিময়ে চুপ থাকছেন বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই চিত্র এখন রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার।

গত ৩ দিন রাজধানীর মিরপুর, পল্লবী, রূপনগর, দুয়ারীপাড়া, উত্তরা, দক্ষিণখান, আদাবর, মোহাম্মদপুর, তুরাগ, হাজারীবাগ, রায়েরবাগ, মুগদা, উত্তরখান, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, কামরাঙ্গীরচর, পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, রামপুরা, বাড্ডা, খিলক্ষেত থানা এলাকা ঘুরে অসংখ্য ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চার্জ দেওয়ার গ্যারেজ নজরে এসেছে। জানা গেছে, বেশি লাভের আশায় এসব এলাকার অধিকাংশ গ্যারেজ চলছে চোরাই লাইনে।

বিদ্যুৎ বিভাগের বখরাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে গত ১৬ মে পল্লবী থানায় অভিযোগ করেন মো. নাজমুল নামে এক গ্যারেজ মালিক। এরপর গত ২৩ মে নাজমুল ও তার বাড়ির মালিক রোকেয়া খানের বিরুদ্ধে এক লাখ ৯ হাজার টাকা জরিমানা করে মামলা দিয়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)।

নাজমুলের কাছ থেকে ঘুষগ্রহণের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে আমাদের সময়ের কাছে। ভিডিওতে নাজমুলের কাছ থেকে গুনে গুনে ঘুষ নিতে দেখা গেছে জাহিদ নামে ডেসকোর এক টেকনিশিয়ানকে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে গত ২৮ মে অভিযুক্ত টেকনিশিয়ানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

নাজমুলের অভিযোগ- ডেসকোর কর্মকর্তা-কর্মচারী জাহিদ, হুমায়ূন, মফিজুল ইসলাম চৌধুরী ও তোফায়েল গ্যারেজে ডেস্কোর অভিযান না দেওয়ার শর্তে মাসোয়ারা হিসেবে প্রতি মাসে ১৫ হাজার করে টাকা নিয়েছেন। গত ১০ মে দুপুর ১টার দিকে জাহিদ তার গ্যারেজে গিয়ে মাসিক কোনো টাকা দেওয়া লাগবে না জানিয়ে এককালীন ৫ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে গ্যারেজে অভিযান চালিয়ে জরিমানার হুমকি দিয়ে চলে যান। এর পরই থানায় অভিযোগ করেন তিনি।

অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে টেকনিশিয়ান জাহিদ আমাদের সময়কে বলেন, একটি মিটার লাগিয়ে দেওয়ার পর খুশি হয়ে নাজমুল ৮০০ টাকা দিয়েছিল। এই টাকা দেওয়ার ভিডিও দেখে ভুল বুঝে কর্তৃপক্ষ আমার চাকরিটা খেয়ে দিয়েছে। গতকাল রবিবার ডেসকোর কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। পরিচয় জানতে পেরে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

নাজমুলের অভিযোগ তদন্ত করছেন পল্লবী থানার এসআই মুন্সি আল আমিন। তিনি বলেন, ঘটনার বিষয়ে জানতে একজনকে থানায় ডাকা হয়েছিল; তিনি আসবেন বলে প্রথমে জানালেও রবিবার পর্যন্ত যোগাযোগ করেননি। তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে।

ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ মালিকরা জানান, প্রতিটি ইজিবাইক (৬০ ওয়াটের পাঁচ ব্যাটারি) ছয় ঘণ্টা চার্জ দিতে ৮ থেকে ১০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। পুরনো ব্যাটারির ক্ষেত্রে আরও বেশি বিদ্যুৎ লাগে। অন্যদিকে প্রতিটি অটোরিকশায় ব্যাটারি থাকে ৩ থেকে ৪টি। সে হিসেবে প্রতিটি অটোরিকশার পেছনে দিনে ৬ থেকে ৮ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। রাজধানীতে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ৮ লাখ ও ইজিবাইকের সংখ্যা ২ লাখ ধরলে প্রতিদিন অন্তত ৮৪ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয় এই দুই অবৈধ পরিবহনে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ধরে প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ যাচ্ছে চুরির খাতায়।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর একটি রিটের শুনানি শেষে ব্যাটারিচালিত অবৈধ যান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একের পর এক দুর্ঘটনার খবরে গত ১৫ মে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরÑ সড়কে অবৈধ এসব যান চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। ওই দিন বিকাল থেকেই রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা চলাচল ঠেকাতে অভিযানে নামে পুলিশ। এর প্রতিবাদে ১৯ মে সকাল থেকে সহিংস হয়ে ওঠেন মালিক-চালকরা। রাজধানীর আগারগাঁও ও মিরপুর ১০ নম্বরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের পাশাপাশি প্রায় অর্ধশত বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা ছাড়াও আগুন ধরিয়ে দেন তারা। দুদিনব্যাপী আন্দোলনের মুখে ঢাকার দুই সিটি এলাকায় ফের অবৈধ এসব যান চালুু করার নির্দেশ দেয় সরকার। নিম্নআয়ের মানুষের কথা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের বরাত দিয়ে শুধু রাজধানীর ফিডার রোডে (মূল সড়ক নয় এমন রাস্তা) ব্যাটারিচালিত ৩ চাকার রিকশা চালু রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানান মন্ত্রী।