দুর্নীতিবাজদের প্রতি সামাজিক ঘৃণা জানানোর এখনই সময়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৯ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দুর্নীতিবাজদের প্রতি সামাজিক ঘৃণা জানানোর এখনই সময়

সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের সম্পদের যে বিবরণ পত্রিকায় আসছে তা পড়ে শেষ করা যাচ্ছে না। কিন্তু পত্রিকাগুলো তো আর নিজেরা লিখছে না। লিখছে দুর্নীতি দমন কমিশনের বরাতেই। বলা হচ্ছে, তিনি এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সম্পদ আহরণে যে, গুলশানে একদিনেই কিনেছিলেন চারটি ফ্ল্যাটি। তার স্ত্রী জ্ঞাতসারে কোনো কাজ না করলেও বাংলাদেশের সেরা ধনী ব্যক্তিদের একজন। বেনজীর শুধু নন, আসছে আরও বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তার অস্বাভাবিক দুর্নীতির খবর। আরও অনেক সরকারি কর্মী সম্পর্কেও খবরাখবর পাওয়া যায়। এদিকে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশ যেন দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। কোন দুর্নীতিটা নেই এখানে সেটাই খুঁজে বের করা যাচ্ছে না। চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট, মাদক ব্যবসা, টাকা পাচার, নিয়োগ দুর্নীতি, ত্রাণ দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো এখন ছোটখাটো হয়ে গেছে। এখন এমন সব দুর্নীতি হয় যে, রাতারাতি প্রায় রাজাধিরাজে পরিণত হন একেকজন ব্যক্তি। পত্রিকার পাতা যখন বেনজীরের খবরে পরিপূর্ণ তখনই জানা গেল পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার নাকি ৫০০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ রয়েছে।

একটি সমাজে একই সময়ে এত রকমের দুর্নীতি ঘটতে পারে, এত মানুষ জড়িয়ে পড়তে পারে সেটা ভাবাই যায় না। কিন্তু ঘটছে। দেখে মনে হচ্ছে দুর্নীতি বিষয়টি এই সমাজে ংবষভ-ৎবরহভড়ৎপরহম বা স্বশক্তিবৃদ্ধিকারী এক বিষয়। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের নানা প্রকার দুর্নীতি দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশটা আসলে ওদেরই দেশ। এখানে দুর্নীতি নিয়ে যত কথা হচ্ছে, দুর্নীতি যেন ততই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এবং সেটা হচ্ছে বলেই আরও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, যার ফলে সমাজে দুর্নীতি আরও বেড়ে যাচ্ছে। কোথাও কেন ভয়ডর নেই। সোজা বাংলায় এর মানে হলো সমাজে যত দুর্নীতি বাড়ে, দুর্নীতি ততই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। এবং সেটা হয় বলেই আরও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, যার ফলে সমাজে দুর্নীতি আরও বেড়ে যায়।

দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদের শত শত বিঘা জমি, অসংখ্য ফ্ল্যাট, বিভিন্ন ব্যবসায় শেয়ারের সন্ধান পেয়েছে। এগুলো সবই হয়েছে সরকারি চাকরি করে, আগে কখনো ছিল না। এর অর্থ হলো তিনি পুলিশে চাকরি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছেন। একই কথা প্রযোজ্য অন্যদের বেলায়ও। ক্ষমতা কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যবহার করে এরা অর্থ উপার্জন করেন এবং তা দিয়ে আরও দুর্নীতি করেন। কারণ দুর্নীতির শক্তিবৃদ্ধিকারী হওয়ার প্রথম কারণ হলো দুর্নীতি থেকে উৎসারিত অর্থ। দুর্নীতিতে যুক্ত যারা, তারা বিপুল অর্থের অধিকারী হয়ে ওঠেন। অর্থ দিয়ে সরকার এবং প্রশাসনের একাংশকে তারা কিনে ফেলেন। এর ফলে দুর্নীতি দেখলেও নেতা-মন্ত্রীদের নির্দেশে প্রশাসনের চোখ বুজে থাকাটাই দস্তুর হয়ে ওঠে এবং দুর্নীতিবাজরা আরও বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার সাহস এবং সুযোগ পান। আরও ফুলেফেঁপে ওঠেন তারা, সমাজে হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে তাদের শাখা-প্রশাখা। এর ফলে আরও অর্থ হাতে আসে দুর্নীতিবাজদের। এবং সেই অর্থের একটি অংশ আবার যায় সরকার এবং প্রশাসনের কাছে, নজরানা হিসেবে। দুর্নীতির চক্র এভাবে চলতেই থাকে নিরন্তর। প্রতিবছর সরকার যে দেখায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে সেটা আসলে এদেরই বাড়ে এবং গড়ে গিয়ে অতি দরিদ্র মানুষেরটাও বাড়তি দেখায়। গত বছর বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদন বলেছিল, দুর্নীতি একটি মৌলিক উন্নয়ন সমস্যা। একদিকে দুর্নীতি দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে তা দরিদ্র ও দুর্বলতমদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে- আয় হ্রাস পাওয়া, ব্যয় বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ন্যায়বিচারসহ পরিষেবা থেকে বঞ্চনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন প্রত্যাশী গরিব দেশে দুর্নীতির এই ব্যাপকতায় চড়া আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের কাছে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার মতো সম্পদের অভাব দেখা দিচ্ছে।

কেন দুর্নীতি বাড়ে? গবেষকরা এর নানা একাডেমিক কারণ খুঁজে বের করতে পারবেন। তবে সাধারণভাবে একটি কথাই বলা যায় আর তা হলো- দুর্নীতিবাজদের প্রতি ক্ষমতা কেন্দ্রের প্রশ্রয়। বেনজীরের মতো মানুষরা একটা সময় মনে করতে শুরু করে যে, তারাই রাষ্ট্র, জনগণ আবার কে? একটা দেশে যদি সুশৃঙ্খল সামাজিক নিয়ম বা রীতি থাকে, যদি কড়া আইন থাকে ও তার যথোপযুক্ত প্রয়োগ হয় তা হলে দুর্নীতি হবে না। সেটা না থাকলে শাস্তি পাওয়ার ভয় কমে যায়। এই ভয় মানুষকে দুর্নীতিমূলক কাজ থেকে বিরত রাখে। বাংলাদেশে এখন সেই ভয়টাই নেই।

সরকারি চাকরি, সরকারি দল আর সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই দুর্নীতি করে এবং তাদের দুর্নীতিই মানুষের জীবনে প্রভাব রাখে। কেউ নিজেকে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত করবে কি না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চারপাশে তাকিয়ে দেখে- বোঝার চেষ্টা করে অন্যরা কী ভাবছে। যখন সে দেখে ওপরের স্তরের মানুষরা নগ্ন হয়ে দুর্নীতি করছে তখন তারা ব্যাপক হারে শুরু করে।

শিক্ষা, সংস্কৃতি, আয়কর, পুলিশ, প্রশাসন, ব্যাংকিংসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে যে দুর্নীতির ব্যাপকতা দেখা দিয়েছে, সামাজিক স্তরে তাকে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ বলে প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও সামাজিক রীতির দুষ্টচক্রের কথা মাথায় রেখে এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে ওদের প্রতি প্রকাশ্য ঘৃণা জানানো শুরু করা দরকার, না হলে বড় দেরি হয়ে যাবে।


সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : সিনিয়র সাংবাদিক