‘বিব্রত’ হওয়া না হওয়া

অজয় দাশগুপ্ত
২৬ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
‘বিব্রত’ হওয়া না হওয়া

বিব্রত আওয়ামী লীগ- এমন খবর রয়েছে সংবাদপত্রে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের যত সংগঠন রয়েছে কেন্দ্র থেকে গ্রামের হাট-বাজার, সবগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন যারা, তাদের সোচ্চার ঘোষণাÑ ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে রয়েছি আমরা’।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই আসে উপজেলা নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেনÑ দলের সংসদ সদস্যদের কেউ প্রার্থী হতে পারবে না উপজেলা চেয়ারম্যান পদে। এ ঘোষণা যুগান্তকারী। স্বজনদের মধ্যে দলীয় পদ ও স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়ুক, সেটা তিনি চাননি। প্রথমবারের মতো এ বিষয়টি সামনে আসায় কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি, আশা থাকবে দলের সর্ব পর্যায়ের নেতারা ভবিষ্যতে তা অনুসরণ করবেন। অন্য দলগুলোর জন্যও তা শিক্ষণীয়।

আওয়ামী লীগের জন্য বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের কলকাতায় নিহত হওয়ার ঘটনা। তিনি পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ‘জনপ্রিয়’ বলেই মনোনয়ন পেয়েছেন, এমন দাবি দলের নেতাদের। কিন্তু মনে রাখতে হবে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ছিল অতিশয় দুর্বল। এ কারণে জনপ্রিয়তা পরীক্ষার সুযোগ মেলেনি। শোকাবহ এ ঘটনার মধ্যেই এ প্রশ্নটিও সামনে আসছেÑ কেবল জনপ্রিয় হলেই কাউকে জাতীয় সংসদ সদস্যপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের মতো একটি দল মনোনয়ন দিতে পারে কি?

জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ এবং তারও আগে পাকিস্তানের সেনাশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান নানা দল থেকে লোক ভাগিয়ে এবং একই সঙ্গে আমলা, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের দলে টেনে নির্বাচনের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপি নামের একটি দল গঠন করেন, যার ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং কমিটি গঠনÑ সব ক্ষমতা ছিল তার হাতে। দলটি গঠনের সাড়ে পাঁচ মাস যেতে না যেতেই জাতীয় সংসদে দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ! কোন সে যাদুমন্ত্র? তখন দেশে ছিল সামরিক শাসনÑ ডাণ্ডাতন্ত্র। কথা বলা ও লেখা নিষিদ্ধ। জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ। এমন পরিবেশে জিয়ার দলের অভাবনীয় জয়!

স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। অভিধানে স্মার্ট অর্থ দেওয়া রয়েছে এভাবে- উজ্জ্বল, নবীনদর্শন, পরিচ্ছন্ন, সুবেশ। স্মার্টনেসÑ সেজেগুজে ফিটফাট হওয়া, চটপটে হওয়া। ঝসধৎঃ- শব্দটির আরও একটি অর্থ দেওয়া আছে এভাবেÑ দেহ-মনে তীব্র ব্যথা অনুভব করা। আওয়ামী লীগ কি ব্যথা অনুভব করার মতো কিছু দেখছে না?

আওয়ামী লীগ যথাযথভাবেই নিজেদের স্বাধীনতার দল দাবি করতে পারে। সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির দলও আওয়ামী লীগ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই এ ভূখণ্ডে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু হয়েছিল। একই সঙ্গে উঠেছিল পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি। এ পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর আত্মদানে অর্জিত স্বাধীন ভূখণ্ডকে সমৃদ্ধ-উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য এ দল এবং তাদের নেতারা বরাবরই রয়েছে আন্তরিক ও দূরদর্শী। এজন্য যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাদের কখনও দ্বিধাগ্রস্ত দেখা যায়নি। স্মার্ট বাংলাদেশ স্লোগানের আগে দলের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। শুরুতে জনমনে দ্বিধা ছিল, কেউ কেউ বিরূপ সমালোচনাও করেছেন। কিন্তু বছর দশেক যেতে না যেতেই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল এমনকি প্রত্যন্ত এলাকাতেও মিলছে। স্মার্ট বাংলাদেশ স্লোগান তাই অবাস্তব কিছু মনে হয়নি।

আওয়ামী লীগ নেতত্বের কাছে স্মার্ট বাংলাদেশ নিশ্চয়ই পরিচ্ছন্ন, সুবেশ কিংবা সেজেগুজে ফিটফাট বা চটপটে হওয়ার মতো বিষয় নয়। স্মার্ট ফোন ব্যবহার বাড়ানো, সেলফি তোলা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি বেশি মানুষকে যুক্ত করার মতো সীমিত পরিসরের বিষয় নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার লক্ষ্য স্থির করেছিলেন ১৯৫২ সাল থেকেই। ষাটের দশকের শুরুতে তিনি স্পষ্ট করে বলেনÑ ‘আমি স্বাধীনতার স্লোগান তুলব’। ১৯৬৬ সালে তিনি স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করে বলেনÑ সাঁকো দিলাম, লক্ষ্য স্বাধীনতা। স্বাধীনতার দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলার জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন। শহর-বন্দর-গ্রামে ঘুরে মানুষকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করেন। একই সঙ্গে নিষ্ঠাবান কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জেনোসাইড শুরুর কয়েক দিন যেতে না যেতেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকার গঠন, লাখ লাখ তরুণকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান ও তাদেরকে অস্ত্রসজ্জিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবিলায় প্রেরণ কোনো আকস্মিক বিষয় ছিল নাÑ সবকিছুতেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছাপ। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই পুত্রও রণাঙ্গনে চলে যান। অথচ সে সময়ে তাদের পিতা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ঢাকায় বন্দি।

এমন একটি দল কাকে কোথায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়ন দিচ্ছে সেটা বিবেচনায় নেবে না? এ দলটি যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু তখন মৃত্যুদণ্ডের হুমকিতে। ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ দম্ভোক্তি করেছিলেনÑ ‘হি উইল নট গো আনপানিশড্।’ কিন্তু সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর উদ্বেগ ছিলÑ অনেক সুবিধাবাদী লোক দলে যুক্ত হচ্ছে, মনোনয়ন চাচ্ছে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসন আমলে তারা কষ্ট করেনি, রাজপথে থাকেনি। তাদের কোনো ত্যাগ নেই। নানা কারণে কেউ জনপ্রিয় হতেই পারে। তা হলেই কি কাউকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন প্রদান করা যায়? এমন ঘটলে তার জন্য কখনও কখনও চরম খেসারত দিতে হয়, সেটাও কি অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি হয়নি? খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে চক্রান্ত করেছিল স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়ার জন্য। তখন তার সাফল্য আসেনি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রধান এই হোতা পরে যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিলÑ ‘১৯৭১ সালের মতো ভুল আর করবেন না। তখন বাংলাদেশ ঠেকাতে পারেননি। এখন মুজিববিরোধী শক্তির পাশে না দাঁড়ালে তারা টিকতে পারবে না।’

স্মার্ট বাংলাদেশ হতে হলে স্মার্ট দল চাই, স্মার্ট কর্মী বাহিনী চাই। জনগণের সঙ্গে অব্যাহতভাবে সংযোগ রাখা চাই। কিন্তু দলের ‘জনপ্রিয়’ নেতারা কি সর্বদা সেটা করেন? অনেক জেলা-উপজেলায় দেখা যায়Ñ যিনি এমপি তিনি পরবর্তী নির্বাচনে দলে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন এমন কাউকে এলাকায় যেতে দেন না। এমনকি ইফতার পার্টি বা ঈদ-পূজায় শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণের মতো কাজ করতে দিতেও প্রবল আপত্তি। উপজেলা নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থীর বাইরে যেন কেউ দাঁড়াতে না পারে সেজন্য সারা বছর তৎপর থাকেন। অথচ এমপি’র পছন্দের এসব প্রার্থী নির্বাচনে ভোটার টানতে পারছেন না। নির্বাচনের আগে যারা মিছিল-সমাবেশ করে তারাও কেন ভোট কেন্দ্রে যায় না? তাদের স্বজনরা কেন ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহবোধ করে না? স্মার্ট দল হয়ে উঠতে হলে এসব বিষয়ে মনোযোগ দিতেই হবে। প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও বিবেচনার বাইরে থাকতে পারে না। বাংলাদেশে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের বিকল্পের কথা বলে। কিন্তু উন্নয়ন-সমৃদ্ধি চাইলে আওয়ামী লীগের বিকল্প একটিইÑ স্মার্ট আওয়ামী লীগ।


অজয় দাশগুপ্ত : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক