কী সংকটে পড়তে পারে ইরান

প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু

ফাহিমা কানিজ লাভা
২২ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কী সংকটে পড়তে পারে ইরান

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পর কে ধরবেন হাল, এই সমীকরণে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন সদ্য প্রয়াত দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। খামেনির বয়স ৮৫, শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। এদিকে ভূরাজনৈতিক কারণে ইরান বর্তমানে গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যা ও আঞ্চলিক উত্তেজনাময় পরিস্থিতি পার করছে। এ অবস্থায় গত রবিবার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানের মৃত্যু ইরানের রাজনীতিকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। সাত মাস আগে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, সিরিয়ায় তেহরানের কমান্ডারদের ও লেবাননে হিজবুল্লাহ নেতাদের টার্গেট করে হত্যার মতো ঘটনাগুলো ইরানি স্বার্থের ওপর যে চাপ তৈরি করে রেখেছে, এসবের মধ্যে রাইসির মতো এত বড় নেতার মৃত্যু যেন সেই চাপ আরও বাড়িয়ে তুলল।

ইব্রাহিম রাইসি, হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান এবং আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার গত ১৯ মে রবিবার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়ি অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়। হেলিকপ্টারের আরোহী ৯ জনই এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। এমন অবস্থায় বর্তমান ইরানি শাসকদের কাছে দেশের ভেতরে ও বাইরে শৃঙ্খলা এবং স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখাটাই প্রাথমিকভাবে বড় চ্যালেঞ্জ।

গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ দশকব্যাপী ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলা ছায়াযুদ্ধকে প্রকাশ্যে এনেছে। গত এপ্রিলে সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় এক কমান্ডারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হন। এর জবাবে ইরানও প্রথমবারের মতো ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। তার এক সপ্তাহের মাথায় ইরানের বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। অন্যদিকে ইরান-সমর্থিত লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে আসছে। এসব ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি আরও বাড়িয়ে তুলছে। সুতরাং রাইসির মৃত্যু ইরানে এবং ইরানের বাইরে স্থিতিশীলতার জন্য স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে রাইসির মৃত্যুতে ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন ঘটবে না বলে মনে করছেন অধিকাংশ বিশ্লেষক।

রাইসি ছিলেন ইরানের সাবেক সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির একজন নিবেদিতপ্রাণ সেবক। ১৯৮০-এর দশকে বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাইসির উত্থান। তিনি ইরাক-ইরান যুদ্ধের শেষে ১৯৮৮ সালে বন্দিদের ওপর মৃত্যুদ- আরোপ করা ‘মৃত্যু কমিটি’র সদস্য হিসেবে বিশেষ পরিচিত হয়ে ওঠেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অনুমান, প্রায় ৫ হাজার নারী ও পুরুষকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছিল ওই সময়, সংস্থাগুলো এটিকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবেও বর্ণনা করে। তবে রাইসি মৃত্যুদ-ে তার ভূমিকা অস্বীকার করে এসেছেন। তিনি উপ-প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং এরপর প্রধান বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০২১ সালের জুনে রাইসিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। তিনি আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অন্যতম আস্থাভাজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সর্বোচ্চ নেতাকে সমালোচনা থেকে বাঁচাতে প্রায়ই সামনে আসতেন রাইসি। এই আনুগত্যের কারণেই ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনেকে ব্যতিক্রমী, এমনকি দুর্বল হিসেবে দেখা সত্ত্বেও রাইসিকে সর্বোচ্চ নেতার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এখন আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাইসির মতো অনুগত ও আস্থাভাজন কে এই জায়গা নেবেন? ইরানের অর্থনীতি ভালো সময় পার করছে না। ২০১৮ সাল থেকে দেশটির মুদ্রার মূল্য ৯৩ শতাংশ কমে গেছে, ইতিহাসে যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এ মুহূর্তে ইরানে ৪০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, কমেছে রিয়ালের মুদ্রার মান। নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া এবং অসংখ্য মানুষ আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেকারত্বও বেড়েছে। সরকার আটক ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিক্ষোভ দমন করছে। কিন্তু সংস্কারের দাবি এখনো ব্যাপক। ২০২২ সালে জারি করা বাধ্যতামূলক হিজাব আইন নিয়ে শাসকদের দমন-পীড়নে মানুষ বিপর্যস্ত। ইরানের বর্তমান শাসকরা সংস্কারপন্থিদের দমন করার চেষ্টা করেছে। ২০২৩ সালেও সরকার ৮৫৩ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর করেছে বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে। ২০১৫ সালের পর এত বেশি মৃত্যুদ- কার্যকর হয়নি।

ইরানের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট মারা গেলে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদনের মাধ্যমে ৫০ দিনের জন্য এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্তর্বর্তীকাল শেষে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। খামেনি নিশ্চিত করেছেন, প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এখন সরকারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মহল সর্বোচ্চ নেতার অনুগ্রহের জন্য কূটকৌশল চালাবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটা অস্থির অবস্থা তৈরি হবে, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থার চাপ তো থাকছেই। কিছু বিশেষজ্ঞ উদ্বিগ্ন যে, যদি খামেনির স্থলাভিষিক্ত হন তার ছেলে মোজতবা খামেনি (৫৫), যাকে একজন কট্টরপন্থি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে তা আরও অস্থিরতা এবং জনগণের বিরোধিতার কারণ হতে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা কে হবেন, তার ওপর নির্ভর করছে দেশটির সমঝোতামূলক বৈদেশিক নীতির অবস্থান।

এমনকি হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ানের দায়িত্বের প্রতিস্থাপনও বেশ জটিল। কারণ তিনি তেহরানের নানা বিষয়, আন্তর্জাতিক মামলা ইত্যাদি বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানোর উপায় খুঁজে বের করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।

রাইসির আকস্মিক মৃত্যু ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতির বহু ক্ষেত্রেই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।