গাজা ইস্যু পশ্চিমের ছাত্রবিক্ষোভ ও আমাদের তারুণ্য

আবুল মোমেন
১৪ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
গাজা ইস্যু পশ্চিমের ছাত্রবিক্ষোভ ও আমাদের তারুণ্য

গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ছাত্রবিক্ষোভ এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে এবং সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনকারী তরুণরা বর্বর হামলা ও গণহত্যার বিরোধিতার পাশাপাশি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের দাবিও তুলে ধরছে। একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইহুদিবাদী (জায়নিস্ট) সংস্থার কাছ থেকে তহবিল গ্রহণ এবং এসব সংস্থায় কোনোরকম সহযোগিতা প্রদান থেকে বিরত থাকার দাবি জানিয়েছে বিক্ষোভরত তরুণরা। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সূচিত আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং তাদের প্রতিবাদের ধরন দেখেই বোঝা যায় এর পেছনে রয়েছে নৈতিক শক্তি ও বিবেকের প্রেরণা। তাদের অন্তরের জোর এতটাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বর্জন করেছে একদল ছাত্র। তাদের হাতে ছিল স্বাধীন প্যালেস্টাইনের পতাকা। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপকও আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।

আরব ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান দেশেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে পুলিশের কঠোর পদক্ষেপ, ব্যাপক ধরপাকড় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শাস্তিমূলক ব্যবস্থায়ও আন্দোলন দমানো যায়নি। কারণ এ আন্দোলনের পিছনে শিক্ষার্থীদের বিবেক ও বিবেচনাবোধ কাজ করেছে। তারা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে। তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে একই বিষয়ে যে সমাবেশ ও কর্মসূচি পালিত হয়েছে তাতে অংশগ্রহণ ভালো হলেও সাধারণ ছাত্রদের প্রাণের উত্তাপ বোঝা যায়নি। এ ছিল নিয়মরক্ষার পরিকল্পিত এক কর্মসূচি। তাই এ সমাবেশ থেকে জোরালো কোনো আওয়াজ ওঠেনি, যার রেশ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েনি।

এটি ছিল প্রতীকী কর্মসূচি, একদিনের নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ কার্যক্রম। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ ও সরকারি বাধা সত্ত্বেও আন্দোলন চলমান রয়েছে। বরং নতুন নতুন দেশে ও ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তা ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আমাদের দেশে ছাত্রসমাজ নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় বসে আছে। চলমান ইসরায়েলি বর্বরতা, জনপদের পর জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা, ৩৫ হাজারের ওপর মানুষ হত্যা, যার মধ্যে নিষ্পাপ শিশুর সংখ্যা পনেরো হাজার। একদিনের কয়েক ঘণ্টার কর্মসূচি পালন করে কি এতে বিবেক ও নৈতিক জবাবের দায় চুকে যায়?

আমাদের তরুণসমাজ অতীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়, যুক্তরাষ্ট্রের কিউবা অবরোধের সময় এবং এ রকম অন্যান্য আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সঠিক অবস্থান নিয়েছে ও রাজপথে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আওয়ামী লীগের আমলে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে দখলদারির ফলে ছাত্র-তরুণদের স্বাভাবিক প্রাণস্পন্দন ও বিবেকি ভূমিকায় ছেদ পড়েছে।

আমরা লক্ষ্য করছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দখলদারির ও দলীয় আধিপত্যের কারণে এক ধরনের অবরুদ্ধ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহপাঠ ও বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক কর্মকা- কিছু কিছু হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা খুবই অল্প। তাই এমন একটা জরুরি মানবিক ইস্যুতে ব্যাপক আকারে ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বা প্রতিবাদী কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থার কারণেই ৩৫ হাজার মৃত্যু এবং নির্বিচার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকলেও আমাদের বড় বড় বিশ্ববিদালয়ে, যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজার বা তদূর্ধ্ব এবং যাদের অধিকাংশই মেধাবী ও বিবেকবান তরুণ-তরুণী বলেই আমরা জানি, সেখানে দীর্ঘ ছয় মাস বিবেক ঘুমিয়ে থাকছে, এটা কেবল বিস্ময়কর নয়, রীতিমতো উদ্বেগজনক। যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার পথে কোথাও বাধা তৈরি হয়েছে- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা মনে করি অবিলম্বে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সরকার এবং সচেতন নাগরিকদের কিছু করা ও বলা দরকার। আমরা আমাদের তারুণ্যকে এভাবে নির্জীব, নিষ্ক্রিয় এবং জবুথবু অবস্থায় দেখতে চাই না। আমরা কিশোর গ্যাং বা তারুণ্যের অপচয় যেমন চাই না, তেমনি তার অসাড়তা বা সময়োচিত মানবিক ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থতা-অপারগতাও কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।

আমরা দেশের তরুণ-সমাজের সুস্থ স্বাভাবিক এবং তরুণোচিত ভূমিকাই কামনা করি। তারা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারে, না শেখে, তা হলে তাদের বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ ঘটবে। আর তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তার অর্থ হলো দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া। সবটা মিলিয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবা জরুরি, প্রতিকার কিছু করার ক্ষেত্রেও সময়ক্ষেপণ ঠিক হবে না।

সেই সঙ্গে আমরা আশা করব, গাজায় গণহত্যা বন্ধের এবং স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ ঘটবে। এটাই প্রাণের লক্ষণ, এটাই ভবিষ্যতের বার্তা।