পশ্চিমের দ্বিচারিতা ও ফাতিমার ডায়েরি

মো. বায়েজিদ সরোয়ার
০৭ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
পশ্চিমের দ্বিচারিতা ও ফাতিমার ডায়েরি

জার্মানির ডাকাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প দেখে যুগলে ইউরোপ ভ্রমণের রোমান্টিকতা ম্লান হয়ে গেল। মিউনিখের নিকটবর্তী ভয়াল মৃত্যুপুরী ‘ডাকাউ’ ছিল নিষ্ঠুর হিটলারের নির্মিত প্রথম বন্দিশিবির, সেখানে হাজার হাজার বিরোধী রাজনীতিক, ভিন্নমতাবলম্বী, কমিউনিস্ট ও ইহুদি বন্দিদের হত্যা করা হয়েছিল। মানুষকে হত্যা, নির্যাতনের এমন নিপুণ প্রতিষ্ঠান দেখে মন বিষণ্নতায় ভরে ওঠে।

এক পর্যায়ে আমরা গ্যাস চেম্বারের পাশে এসে দাঁড়াই। ইতিহাস বলে, এই গ্যাস চেম্বারটি বন্দি হত্যায় ব্যবহৃত হয়নি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের আউসভিৎজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো অনেক ক্যাম্পে লাখ লাখ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারা হয়। এর অনেকদিন পর, গাজায় প্রায় মিডিয়ার সামনে সংঘটিত ইসরায়েলি গণহত্যা, জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ‘ইহুদি হলোকস্ট’-এর কথা মনে করিয়ে দিল। তবে এখন একেবারে বিপরীত দৃশ্যপট। এবার ‘বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে পরিচিত গাজায় ইহুদিদের হাতেই নিষ্ঠুর গণহত্যার শিকার হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ‘নব্য হিটলার’ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সামরিক বাহিনী শুধু ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে না। অজান্তে খোদ ইসরায়েলের ধ্বংসের বীজও বুনছে।

গত ৭ অক্টোবর থেকে হামাস কর্তৃক ইসরায়েলে আক্রমণের প্রতিশোধে প্রায় ৭ মাস ধরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনিদের ওপর বীভৎস এক গণহত্যা চালাচ্ছে। এমন বীভৎস গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি শক্তিশালী দেশ। অন্যদিকে রাশিয়ার আগ্রাসনে বিপন্ন ইউক্রেনের লড়াকু জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ। ফলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতা বা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। তবে আশার কথা, গাজার এই গণহত্যার প্রতিবাদে প্রবলভাবে জেগে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। লেখক জনাথন কুক লিখেছেনÑ ‘ফিলিস্তিনি হত্যার রক্তের দাগ পশ্চিমাদের হাতে সমানভাবে লেগে আছে।’

ইসরায়েলের আইডিএফ বাহিনীর বর্বর আগ্রাসনে গাজায় যেন কেয়ামত নেমেছে। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনিরÑ এমনটা জানিয়েছেন গাজার স্বাস্থ্য দপ্তর। গাজা এখন একটি বিশাল ধ্বংসস্তূপ। ‘গণহত্যা বিশেষজ্ঞ’ মিয়ানমারের নাগরিক মুয়াং জার্নি গাজার গণহত্যার সঙ্গে জার্মানির আউসভিৎজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের তুলনা করেছেন। তিনি লেখেনÑ ‘এটি আউসভিৎজের পুনরাবৃত্তি’ ও ‘গ্যাস চেম্বার ছাড়া মানুষ হত্যা।’ ইসরায়েলকে অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্র সমর্থন করায় এই গবেষক আরও লিখেছেনÑ ‘এটি শুধু ইসরায়েলের গণহত্যা নয়, এটি সম্মিলিত গণহত্যা।’

ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান ব্যাপকভাবে সমালোচিত। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মন দখলের লড়াই চলমান। এডওয়ার্ড এস হারম্যান এবং নোয়াম চমস্কি ১৯৮৮ সালে গণমানস নিয়ন্ত্রণ তথা মন দখলের উদ্দেশ্য প্রচার কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট : দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য মাস মিডিয়া’ নামে একটি মাস্টারপিস গ্রন্থ রচনা করেছেন। অধ্যাপক আ-আল মামুন এই মাইলফলক গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ (২০০৮) করেছেনÑ ‘সম্মতি উৎপাদন : গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি।’ বইটিতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম পাঠক ও দর্শকদের মগজ ধোলাই করতে ব্যবহৃত হয়।

ফিলিস্তিনির ওপর ইসরায়েলের গণহত্যাকে ঢেকে রাখতে পশ্চিমা, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম তাদের বার্তা নীতিতে এক ধরনের কাঠামো ব্যবহার করছে। যদি কোনো স্থানের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর বা জাতি মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে থাকে, তা হলে সেই নিপীড়িত অত্যাচারিত ‘মজলুম’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার সমবেদনা পাওয়ার ‘যোগ্য’ হিসেবে ইতিবাচক প্রচারণা বা কাভারেজ পায়। যেমন ‘ইসরায়েল’ পশ্চিমাদের গণমাধ্যমে ‘সাহায্য পাওয়ার যোগ্য আক্রান্ত মজলুম’ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে অত্যাচারে বিপন্ন ফিলিস্তিনিরা হয়ে যায় ‘সন্ত্রাসী’। সময়ের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নিজেই ‘হিটলারের’ ভূমিকা পালন করছেন, ফিলিস্তিনি মুসলমানরা ইহুদিদের হাতে গণহত্যা বা ‘হলোকস্টের’ শিকার হয়েছে। এক সময়ের ‘মজলুম বা অত্যাচারিত’ আজ ভয়াবহ ‘গণহত্যাকারীর’ ভূমিকায়। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমে সুকৌশলে তা চেপে রাখছে। অন্যদিকে পশ্চিমা গণমাধ্যমে অনেক সময় হামাস বা ফিলিস্তিনিদের দানবায়ন বা ডিহিউমেনাইজ করা হয়। ১৯৬৭ সালের পর ইসরায়েলের পরামর্শকরা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতাকে ‘ইহুদি বিরোধিতা’ বা ‘অ্যান্টি সেমেটিজম’ বলে ব্যাপক প্রচার করে। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি ‘নির্যাতনকে পুঁজি’ হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। এই ধরনের প্রচারণার ফলে পশ্চিমা গণমাধ্যমের ইমেজ অনেকটা ক্ষণ্ন হয়েছে।

গণমাধ্যমের এই পরিস্থিতিতে প্রয়াত বরেণ্য আইরিশ ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক রবার্ট ফিস্কের অনুপস্থিতি অনুভূত হচ্ছে। ‘যুদ্ধ সাংবাদিক’ হিসেবে ফিস্ক নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ও সাহসিকতার জন্য ফিস্ক সমধিক পরিচিত। রবার্ট ফিস্কের তীক্ষè অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলোতে চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যা বয়ানগুলো অসংখ্যবার অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। গাজা যুদ্ধ ও ক্ষুধার বিভীষিকার মধ্যেই সাংবাদিকরা অসাধারণ কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দায়িত্ব পালনকালে প্রায় ১০০ জন সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই ফিলিস্তিনি।

জার্মানিতে ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী কিশোরী আনা ফ্রাংকের ডায়েরি (দ্য ডায়েরি অব এ ইয়াং গার্ল) বিশ্ববিখ্যাত। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে আনা ফ্রাংকের পরিবার ধরা পড়ার ভয়ে গুদাম ঘরের এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রায় ২ বছর লুকিয়ে ছিল। ১৫ বছরের কিশোরী আনা ফ্রাংক তার ডায়েরিতে তাদের কীটপতঙ্গের মতো বেঁচে থাকার জীবনের খুঁটিনাটি বিবরণ নিয়মিত লিখে রাখত। কিন্তু একদিন জার্মানির নাজি গোয়েন্দাদের হাতে ইহুদি পরিবারটি ধরা পড়ল। প্রথমে ওদের আউসভিৎজ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর ট্রেনে বেলসেন ক্যাম্পে। এখানেই ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে মৃত্যু হয় আনার। আনার ডায়েরি পরে ৭০টি ভাষায় অনূদিত হয়। নেদারল্যান্ডসে ভ্রমণটি স্বল্পকালীন হওয়ায় আমস্টারডামের আনা ফ্রাংক মিউজিয়ামে আমার যাওয়া হলো না।

গাজার ধ্বংসস্তূপে হাজারো ফিলিস্তিনির লাশ মিশে আছে। আমি ভাবছিলাম গাজা সিটির ১৫ বছরের এক ফিলিস্তিনি কিশোরীর কথা। ধরা যাক তার নাম ফাতিমা। আনা ফ্রাংকের মতো ফাতিমাও নিয়মিত ডায়েরি লিখত। বর্তমান গাজা যুদ্ধের আগেও গাজাবাসীর জীবন ছিল ভয়ঙ্কর কষ্টের। ইসরায়েলের বর্বর নীতির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি ও বিদ্যুতের অভাবে তাদের জীবন ছিল দুর্বিষহ। বিমান আক্রমণের ভয় তো ছিলই। বর্তমান যুদ্ধের শুরুতে একদিন ইসরায়েলের বিমান আক্রমণে গাজাসিটির ফাতিমাদের অ্যাপার্টমেন্টটি ধ্বংস¯ূÍপে পরিণত হয়...। গাজার যুদ্ধ একদিন বন্ধ হবেই। এর পর ধ্বংস¯ূÍপ সরিয়ে নতুন শহর ও দেশ গড়ার কাজ শুরু হবে। একদিন হয়তো বুলডোজারের ব্লেডে উঠে আসবে কিশোরী ফাতিমার দেহাবশেষ... ও একটি ডায়েরি। ফাতিমার ডায়েরি পড়ে লাখ লাখ মানুষ একদিন হয়তো গাজায় ফিলিস্তিনিদের ভয়াবহ জীবনযাপনের কথা জানতে পারবে।

তবে গাজার যুদ্ধ ও গণহত্যা মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্র ও নাগরিক সমাজ ইসরায়েলের হামলা বন্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ করছে। মার্কিন সমাজের এ এক অ™ু¢ত সৌন্দর্য। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে ১৩টি দেশে। এর পথ দেখিয়েছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউইয়র্ক ক্যাম্পাসের ছাত্ররা, যা শুরু হয়েছে ১৭ এপ্রিল।

ইসরায়েলের সমাজের মধ্যে থেকেও ব্যাপক প্রতিবাদ হচ্ছে। ইতিহাসবিদ ইয়াভাল নোয়াহ হারিরি গাজায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও মানবিক ট্র্যাজেডি তৈরির জন্য নেতানিয়াহুর পলিসিকে দায়ী করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ও মানবিক বিপর্যয় ইসরায়েলের নৈতিক অবস্থান ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার জন্য চুক্তির দাবিতে গত শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত ইসরায়েলের হাজার হাজার মানুষ তেলআবিবে বিক্ষোভ করেছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তির জন্য কায়রোতে গত শনিবার থেকে উভয় পক্ষের মধ্যে জোর আলোচনা চলছিল। এর আগে ২৬ মার্চ গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হলেও ইসরায়েল তা মান্য করেনি। যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে অনড় উভয় পক্ষ। দুপক্ষের এমন অনড় অবস্থানের জন্য গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী রাফায় আক্রমণের কথা বলেছেন।

মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব কমলেও এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা গাজার যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। এখনই যুদ্ধের লাগাম টানতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলকে আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধ করতে বাধ্য করা। হঠকারী নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ সেনা অধিনায়করা মধ্যপ্রাচ্যে একটা ভয়াবহ আঞ্চলিক যুদ্ধ উস্কে দিতে পারে।

দুই রাষ্ট্রের ফর্মুলা অনুযায়ী সমাধান খোঁজা উচিত- যার মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য শান্তি নিহিত। হামাসের উচিত উগ্রপন্থা পরিহার করা। তবে তার উপযোগী পরিবেশও তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পশ্চিমা বিশ্বের উচিত দ্বিচারিতা, দ্বিমুখী নীতি ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্যে সত্যিকারের শান্তির জন্য কাজ করা। বন্ধ হোক গাজার এই ভয়াবহ যুদ্ধ ও গণহত্যা। শান্তি নামুক ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে।


মো. বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও গবেষক