আট ঘণ্টা বিপ্লবের জন্য সংগঠন

মনজুরুল আহসান খান
০১ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আট ঘণ্টা বিপ্লবের জন্য সংগঠন

আঠারোশ সালের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন শিকাগোতে খুব জোরদার হয়ে ওঠে। কলকারখানার মালিকরা এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা বলে, শ্রমিকরা কমিউনিস্টদের উসকানিতে রাস্তায় নেমেছে। কমিউনিস্টদের দার্শনিক কার্ল মার্কসই বলেছিল, শ্রমিকরাই একমাত্র মেহনতি মানুষের মুক্তি আনতে পারে আর সেজন্য শ্রমিকদের সংগঠিত হতে হবে। কিন্তু সংগঠন গড়তে হলে কাজের সময় কমিয়ে আনতে হবে। কেননা বেশি সময় পরিশ্রম করলে তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, সংগঠন গড়ার সময় থাকে না। তাই সারাদিনটাকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম এবং আট ঘণ্টা সংগঠন ও সংগ্রাম। এই কথা মনে রেখেই আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। পহেলা মে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকরা সপরিবারে একত্রিত হয় সভা করার জন্য। বসন্তের আগমন উপলক্ষে ঐতিহ্যগতভাবে মানুষ একত্রিত হয়ে উৎসব করত। সেদিনও উৎসব করতে ও দাবি জানাতে মানুষ জমায়েত হয়েছিল। ধনিকশ্রেণির চক্রান্তে কিছু গু-া পুলিশের ওপর বোমা ফেলে। এই অজুহাতে পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালায়। অনেক নারী-শিশুসহ হতাহত হয়। বহু গ্রেপ্তার ও দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়। চারজন শ্রমিকনেতার ফাঁসি হয়। পরে শিকাগোর গভর্নর স্বীকার করেছিলেন যে, ওটা ছিল বিচারের নামে প্রহসন। ফাঁসির আগে একজন চিৎকার করে বলেছিল, ‘তোমরা ফাঁসি দিয়ে আমাদের কণ্ঠরোধ করতে পারবে না, সারা বিশ্বের শ্রমিক একদিন আমাদের স্লোগানের প্রতিধ্বনি করবে। তাই হয়েছিল। সারা বিশ্বের মানুষ গর্জে উঠেছিল। আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। অবাক লাগে যখন দেখি ১৮৩৮ সালেই কলকাতার রেল শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘট করেছিল।

১৮৭১ সালে প্যারিসের সশস্ত্র বিপ্লবে সেখানে শ্রমিকরা ক্ষমতা দখল করেছিল। বাহাত্তর দিন বিপ্লব টিকে ছিল। তখন ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু তারা যুদ্ধ স্থগিত রেখে প্যারিকমিউনের ওপর হামলা চালান। ৩০ লাখ বিপ্লবী শহীদ হলো। তাদের গণকবর হলো। অনেকে বেঁচেছিল। একজনের মুষ্টিবদ্ধ হাত মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছিল, সেই থেকে লাল সালাম প্রচলিত। শিকাগোতে গোলাগুলির সময় রক্তাক্ত কাপড় নিয়ে পতাকা তৈরি করে মিছিল শুরু হয়। এটাই হচ্ছে লাল পতাকার জন্মকাহিনি। প্যারিকমিউনের পর নির্বাচিত মেয়র ছিলেন ইউজিন পাটয়ার। তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তিনি পলাতক ছিলেন এবং অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। তার বিছানার নিচে একটি কবিতা পাওয়া যায়। সেটাই এখন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। সারা বিশ্বেই গাওয়া হয়।

১৮৭৯ সালে প্যারিস শহরে সমাজতন্ত্রী শ্রমিকনেতাদের একটি সম্মেলন হয়। সম্মেলনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। এক. প্রতিবছর পহেলা মে শ্রমিকরা সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ, ধর্মঘটের মাধ্যমে দিবসটি পালন করবে। তারা তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরবে। দুই. বিপ্লব ও ক্ষমতা দখল করতে হলে শ্রমিকশ্রেণিকেই তার নিজস্ব দল গঠন করতে হবে। তখন থেকে প্রতিবছর পহেলা মে বিশ্বের দেশে দেশে মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রথমদিকে আমেরিকায় দিবস পালন নিষিদ্ধ ছিল। এখন সেখানেও পালিত হয়। আমাদের দেশেও দাবি-দাওয়া তুলে ধরা, আন্দোলনের শপথ নেওয়া এবং বিশ্বের শ্রমিক-জনতার প্রতি সংহতি জানানো হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পহেলা মে ছুটি ঘোষণা করেন।

এবারও মে দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে। সমাবেশ-মিছিলে জাতীয় শ্রমিক-কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ ১১ দফা দাবি উচ্চারিত হবে। সমাবেশে মিছিলসহ ফিলিস্তিনে গণহত্যার নিন্দা করা হবে। তাদের সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানানো হবে। ইতোমধ্যে শ্রমিকরা প্রায় দুই লাখ টাকা সংগ্রহ করে ফিলিস্তিন দূতাবাসে জমা দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও দেবে। আশা করি ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে। বিশ্বের মানুষ মুক্তি পাবে। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হবে। দুনিয়ার মজদুর এক হও স্লোগানটি সার্থক হবে।


মনজুরুল আহসান খান : বর্ষীয়ান শ্রমিকনেতা ও রাজনীতিক